মঙ্গলবার ৩রা বৈশাখ ১৪৩১ Tuesday 16th April 2024

মঙ্গলবার ৩রা বৈশাখ ১৪৩১

Tuesday 16th April 2024

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

টিকাপ্রদানে বৈষম্যের শিকার শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী

২০২১-০৭-২৯

দৃকনিউজ প্রতিবেদন

টিকাপ্রদানে বৈষম্যের শিকার শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী

 

দেশে করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই কল-কারখানা খোলা রাখায় ঝুঁকি নিয়ে কাজে যেতে বাধ্য হন শ্রমজীবীরা
কিন্তু অগ্রাধিকারভিত্তিতে টিকাপ্রদানের পরিকল্পনায় তাদের কথা ভাবা হয়নি
টিকাপ্রদান কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় সুবিধাবঞ্চিত নিম্ন আয়ের মানুষ চাইলেও টিকা নিতে পারছেন না

 

করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে এ অবধি সরকারের কোনো পরিকল্পনায় দৃশ্যমান হয়নি দেশের শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা। দেশে কোভিড সংক্রমণের শুরু থেকেই সরকার ঘোষিত ‘ফ্রন্টলাইনার’ বা সম্মুখসারির সেবাদাতাদের পাশাপাশি ঝুঁকি নিয়ে কর্মরত রয়েছে বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশ। নিম্নবিত্ত শ্রেণির এই মানুষগুলো সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক টিকা কার্যক্রম তালিকায় নেই, বরং এদের করোনা হয় না এমন ভ্রান্তিই যেন সর্বস্তরে বিদ্যমান! অন্যদিকে সুবিধাবঞ্চিত গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে সরকারের টিকা পৌঁছানোর রূপরেখাও এখনো অনুপস্থিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা থেকে টিকা কার্যক্রম, শ্রমজীবীদের ক্ষেত্রে সব পর্যায়েই গোচরীভূত হয়েছে বৈষম্য। টিকার স্বল্পতা এই পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলেছে।

 

গরিবের কোভিড হয় না!

 

‘করোনাভাইরাস বড় লোকের রোগ, গরিবের কোভিড হয় না’– এমন ভ্রান্তি দেশের সাধারণ মানুষের মাঝেই বিরাজমান নয়, খোদ সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও যেন বরাবরই তা মেনে চলছেন! কারণ দেশে করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে এ পর্যন্ত আক্রান্ত-শনাক্ত পরীক্ষা, চিকিৎসা ও টিকা প্রদান কর্মসূচিতেও দৃশ্যমান হয়নি দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী।

 

তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা করোনার শুরু থেকেই কাজে যেতে বাধ্য হয়েছেন তেমন কোনো সুরক্ষা ছাড়াই। ২০২০ সালের ৪ জুন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর তৎকালীন সভাপতি ড. রুবানা হক বলেছিলেন, ‘যে তুলনায় শ্রমিকদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার কথা ছিল, সংখ্যাটি কিন্তু সেই তুলনায় খুবই কম! কারণ গরিব মানুষের এক ধরনের শক্তি থাকে, লড়তে জানে। তারা সচেতন এবং তারা অসুস্থ হবে না বলেই ধরে নেন। সেই শক্তি নিয়েই তারা কাজ করেন।’

 

অথচ গত বছর মে মাসে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের এপ্রিলে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার পর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫২ শতাংশ শ্রমিক। শ্রমজীবীদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার এমন তথ্য গবেষণায় উঠে এলেও এ নিয়ে মালিকপক্ষ কিংবা সরকারকে উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়নি।

 

সাভারের পোশাক শ্রমিক ডালিয়া (ছদ্মনাম) দৃকনিউজকে জানান, ‘কয়েকদিন আগেই আমার এক সহকর্মীর জ্বর আসে। সকালে কারখানায় আরও খারাপ লাগতে থাকায়, সে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানায়। কর্তৃপক্ষ প্রথমে পরীক্ষা করাতে বললেও পরে বলে, কিছু করতে হবে না। আমরা হেল্প করতেছি। পরে আর কিছুই করে নাই। শরীর খারাপ নিয়াই সে কাজ করেছে।’

 

ঢাকার লোকাল বাসচালক হারুন। তিনি দৃকনিউজকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে জ্বর-ঠাণ্ডার সঙ্গে শরীর ব্যাথা ছিল। ঠাণ্ডায় এমন কষ্ট আগে হয় নাই! করোনা হইলে হইছে, তয় এইটারে পাত্তা দিলে পেট চলবে না। পরিবার বাইত (বাড়িতে) থাকে, ভালা আছে।’

 

 নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের একজন কারখানা পরিদর্শক এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন দৃকনিউজ-এর সঙ্গে। এই প্রতিবেদক তার সঙ্গে আলাপ করার সময় তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসারত। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এত সুরক্ষা নিয়েও আক্রান্ত, তাইলে তাদের কী অবস্থা! আমরা যখন যাই, তখন তারা কিছুটা মেনে চলছে দেখায়। তাই বলতে দ্বিধা নাই, তারা যেভাবে কাজ করছে- এটা বিপজ্জনক। বোঝা যায়, মালিক-শ্রমিক এক ধরনের সমঝোতা চলে। আর শ্রমিকরা তো সচেতন না। বিশেষ করে কম বয়সি শ্রমিকরা, তারা মনেকরে তাদের ঝুঁকি কম।’

 

‘গরিবের করোনা হয় না, এটা এস্টাবলিশ ধারণা না’ এ বিষয়ে একমত স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. নাসিমা সুলতানা। তবে নিম্ন আয়ের মানুষের করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি দৃকনিউজকে বলেন, ‘ঢাকায় আগে যখন কোভিড বেশি ছিল তখন দেখা গেছে যে, নিম্নবিত্ত মানুষের মাঝে কোভিড আসে না। এখানে ভ্যারিয়েন্ট একটা বিষয়। বিশেষ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি। এখন সংক্রমণ বেশি হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষও আক্রান্ত হচ্ছেন।’

 

এই বক্তব্যের সমালোচনা করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, ‘গরীবের কোভিড- ১৯ হয় না, এই মিথের সঙ্গে কখনো একমত ছিলাম না। সব সময় বলেছি যারা অপুষ্টিতে থাকে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। সুতরাং কোভিড হবে না, এটা হতে পারে না। শহরাঞ্চলের ঘিঞ্জি এলাকা ও গরীব মানুষ আগেও আক্রান্ত হয়েছে, সেটা মৃদু ও উপসর্গহীন হলেও ক্যারিয়ার (সংক্রমণ) তো ছিলই। এখন এই মাত্রাটা আরও বেশি। তাই শঙ্কিত বোধ করছি যে গ্রাম ও বস্তিগুলোতে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ থাকে। এখন বুঝতে হবে তারা ঝুঁকিতে আছেন।’

 

গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির কেন্দ্রীয় সদস্য বাবুল হোসেন দৃকনিউজকে জানান, চাকরি হারানোর ভয় ও ঝামেলা এড়াতেই করোনাভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ গোপন করেন শ্রমিকরা। পোশাক কারখানাগুলোর করোনা পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘শুরুতে কোনো শ্রমিকের জ্বর-ঠাণ্ডা দেখা দিলে তা জানানো হলে পরীক্ষা করতে বলত কারখানা কর্তৃপক্ষ। করোনা পরীক্ষা ও সেরে ওঠার পর কর্মস্থলে গেলে পুনরায় পরীক্ষা করে রিপোর্ট নিয়া আসতে বলত। এটা শ্রমিকের জন্য অনেক কষ্টকর। আর কোথায়, কিভাবে পরীক্ষা করাবে এই নিয়ে কারখানা মালিকদের কোনো উদ্যোগ নেই। এমনকি অনেক কারখানাতে ১০ থেকে ১৫ দিন পর ফিরলে শ্রমিকদের আর রাখেনি। এ কারণে দেখা গেছে একপর্যায়ে উপসর্গ দেখা দিলেও শ্রমিকরা আর কারখানাকে জানাত না। এখনও তাই চলছে, কেউ বলে না।’

 

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদের মতে, ‘সরকারের পরিকল্পনায় অদক্ষতা আর ধনীদের অতি লোভেই শ্রমজীবীদের এই দশা! শ্রমিকের জীবনের বিনিময়েও কারখানা মালিকদের লাভ করতেই হবে। সরকারও সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। অথচ এই কারখানার মালিকরা কিন্তু ঠিকই প্রণোদনা নিয়েছেন, নানা ধরনের সুবিধা নিয়েছেন!’

 

করোনা পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস খোলার বিরোধিতা করে আইইডিসিআরের সাবেক এই পরিচালক বলেন, ‘আমরা আগের লকডাউনগুলোতে গার্মেন্টস খোলা রাখা সমর্থন করিনি। সব ধরনের পরিবহন বন্ধ রাখতে বলেছি। আমরা বলেছি তাদের জন্য সোশাল সেফটি নেটওয়ার্কের তৈরি করতে। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী, স্বল্প আয় ও কর্মহীন হয়ে পড়া সকলকেই এর আওতায় আনতে বলেছি। রিকশাচালকদের, শ্রমিকদের যদি মাত্র ১০ হাজার টাকাই দিতাম এরা কিন্তু রাস্তায় আসতো না। টাকা কিন্তু বিষয় ছিল না। তৈরী পোশাক কারখানার মালিকরা অনেক সুবিধা নিয়েছেন। নানা ধরনের প্রণোদনার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং টাকার যোগান তো ছিলই।’

 

টিকাপ্রদানে বৈষম্য

 

সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক গোলাম আজম (৪০) পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তিনি দৃকনিউজকে বলেন, ‘ভাইরাস কি আর ধনী-গরীব চেনে? গত বছর থেকে এ পর্যন্ত কত রোগী নিয়া গেছি হাসপাতালে। দেখলেই তো বুঝি কিসের রোগী। কিন্তু কখনো জীবনের ভয় করি নাই। হাঁচি-কাশি দেয়, পেছনে রোগীর সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তো বেশি না। টিকা নিতে চাই, অনলাইন করতে হবে এর মধ্যে সময় চইলা গেছে। আবার আসলে নিবন্ধন করব।’

 

তবে অটোরিকশাচালক গোলাম আজম কিংবা গার্মেন্টসকর্মী ডালিয়ার মতো শ্রমজীবীদের টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নেই। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত লকডাউনগুলোতে শ্রমজীবীদের অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। আবার পেটের দায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের হয়রানিরও শিকার হয়েছেন! বাস্তবতা এই যে বরাবরেরই মতোই চলমান শাটডাউনেও চালু রয়েছে বিভিন্ন শিল্প ও কল-কারখানা। রিকশাচালক, হকার, দোকানকর্মী কিংবা কাঁচাবাজারের বিক্রেতারা এই মহামারি পরিস্থিতিতে জরুরি সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

 

ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার চালান বন্ধ হয়ে গেলে গত এপ্রিলে থমকে যায় প্রথম দফার টিকাপ্রদান কার্যক্রম। সম্প্রতি চীনের সিনোফার্ম ও কোভ্যাক্স থেকে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা পাওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সরকার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দ্বিতীয় ডোজ না পাওয়াদের পাশাপাশি এবারের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছেন দেশে আটকে পড়া প্রবাসী শ্রমিক, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, সরকার প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থী ও আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া সিনোফার্মার টিকার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন দেশে কর্মরত ও অবস্থানরত চীনা নাগরিকরা।

 

সরকারের এই পরিকল্পনা থেকে দৃশ্যমান যে, শ্রমজীবী মানুষের যে অংশ কোভিডে সম্মুখসারিতে থাকতে বাধ্য হয়েছেন, অগ্রাধিকারভিত্তিতে টিকাপ্রদানের পরিকল্পনায় তারা নেই। আর সর্বজনের জন্য যে টিকাপ্রদান ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তাতে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হয়। নিম্নবিত্ত, গ্রামাঞ্চলের মানুষ কিংবা নিম্ন আয়ের মানুষ যারা ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নন, তারা এই সুযোগ নিতে পারেননি। সরকারের নতুন পরিকল্পনায় টিকাগ্রহীতাদের বয়সসীমা কমিয়ে ৩৫ বছর করার কথা বিবেচনা করা হলেও শ্রমজীবী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে টিকা নিবন্ধনের বিষয়টি সেখানেও তালিকার পেছনেই রয়ে গেছে।

 

অনলাইন নিবন্ধনের মধ্য দিয়ে টিকা সরবরাহ পদ্ধতিটাই মূল সমস্যার কারণ বলে মনে করেন, আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ। এই মানুষদের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই বলেই সরকার তাদের ঝুঁকিতে ফেলেছে বলেও অভিযোগ তার। দৃকনিউজকে তিনি বলেন, ‘আমরা কখনো বলিনি, বস্তির লোক টিকা পাবে না, গ্রামের লোক টিকা পাবে না। যে পদ্ধতিতে টিকা নিবন্ধন করানো হলো এটাই সমস্যা বাঁধিয়েছে। এটা আমাদেরকে জিজ্ঞেস করেনি। জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয়ই পরামর্শ দিতাম, এমন একটা পদ্ধতি যেটা সর্বজনীন। আপনাকে চিন্তা করতে হবে শিক্ষা বঞ্চিত মানুষ, গরীব মানুষ, সবার স্মার্টফোন আছে কিনা? অর্থাৎ এরা গুরুত্বপূর্ণ (সরকারের কাছে) না!’

 

 সুবিধাবঞ্চিত ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের টিকার বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘বিত্তের সঙ্গে টিকার সম্পর্ক নেই। গোটা বিশ্বেই এখন টিকা সংকট। স্বাস্থ্যসেবা, নিবন্ধন উন্মুক্ত। টিকা এলে পর্যায়ক্রমে সবাইকে দেয়া হবে।’

 

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সরকারের দায়িত্বশীলদের এমন মন্তব্যে স্পষ্ট যে, এখন পর্যন্ত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর টিকা প্রাপ্তির বিষয়টি অনিশ্চিত রয়ে গেছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিভাগের নেতৃত্ব নেই বলেও অভিযোগ তাদের। মহামারি ব্যবস্থাপনায় সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের অভাবকেও দুষছেন কেউ কেউ।

 

এ প্রসঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘সরকার এখন পর্যন্ত সকল রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে ডেকে কথা বলছে না। এই যে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের বাচ্চারাই দেখিয়েছে নিরাপত্তা কী হবে? এরা শতভাগ লোককেই মাস্ক পরানো থেকে শুরু করে, সামাজিক দূরত্ব সব শেখাবে। এই স্কাউট, গার্লস গাইড, শিক্ষার্থীদের কাজে লাগান। যুব শক্তিকে কাজে লাগান।’

 

অরক্ষিত শ্রমজীবী ও গ্রামাঞ্চলের মানুষ

 

সরেজমিনে শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে দেখা হয় কেরানীগঞ্জের আব্দুল মালেক (৬২) ও সাভারের আসলামের (৭০) সঙ্গে। তারা কৃষিকাজ করেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালের তিনটি কোভিড ওয়ার্ডে দেখা যায়, সাভার, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, গাইবান্ধা ও রংপুরসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশ কয়েজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। করোনাভাইরাসের টিকা নিতে চান কিনা জানতে চাইলে, প্রত্যেকের পরিবারই টিকা নেওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। অনলাইন নিবন্ধনের কথা জানেন কেউ কেউ আবার অনেকেই জানেন না কোথায় পাবেন, কিভাবে পাবেন। আগের মতো বিনামূল্যে মিলবে কিনা, এ নিয়েও সংশয় রয়েছে। আসন্ন পরিস্থিতি নিয়ে অনিশ্চিত আক্রান্তদের পরিবারগুলো জানায়, কম দামে এবং জেলা-উপজেলার বাইরে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা সরবরাহ হলেই হয়তো টিকা নিতে পারবেন তারা।

 

এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখার পরেও করোনাভাইরাসের ‘ডেল্টা’ ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। চিকিৎসকরা ধারণা করছেন, এ মুহূর্তে সীমান্তবর্তী অঞ্চল হয়ে দেশের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে করোনার নতুন এই ধরন। অথচ সুবিধাবঞ্চিত ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে সরকারের টিকা পৌঁছানোর রূপরেখা এখনো অনুপস্থিত।

 

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ঠেকাতে শুরুতেই গ্রামাঞ্চলে নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আসছে কোভিড ১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। কিন্তু জোরালো কোনো উদ্যোগ এখনো নেয়া হয়নি। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কোভিড চিকিৎসায় পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। এক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়ানোর যথেষ্ট সময় পাওয়া গেলেও তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।

 

বর্তমান বিপর্যয় তুলে ধরে ‘এই সরকার গরীবের না’ বলে আখ্যা দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ‘সরকারের অদক্ষতা ও অপরিপক্বতার কারণে টিকার সমবন্টন হবে না’ বলে মতপ্রকাশ করেন তিনি। দৃকনিউজকে তিনি বলেন, ‘যারা শহর ছেড়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে তাদের টিকা দেওয়ার কথা ভাবে না। সরকারের কাছে এখনো পর্যাপ্ত টিকা নেই। সময়মতো কাজ করলাম না! আমার এ বছরই ১২ কোটি টিকা দরকার। এসব আমলে না নিয়ে শুধু অন্যের দোষ খুঁজে লাভ হবে না।’

 

ঝুঁকি বিবেচনায় গ্রামাঞ্চল ও শ্রমজীবী মানুষের টিকাকরণ এখন অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত বলে মনে করছেন, জনস্বাস্থ্যবিদ ও রোগ সংক্রামক বিশেষজ্ঞরা।

Your Comment