শুক্রবার ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ Friday 17th May 2024

শুক্রবার ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

Friday 17th May 2024

বহুস্বর মতামত

গণতন্ত্রের শক্তিতে এক দুর্ধর্ষ রাজনৈতিক হাতিয়ার মিম

২০২২-০৯-০৭

সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ

হিটলার লাখ লাখ মানুষ মারলেও তিনি নাকি একজন মানুষের আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি চার্লি চ্যাপলিন। হিটলারের মতোই ‘বোতলবুরুশ’ মোচ নিয়ে তিনি হিটলারকে কটাক্ষ করেন ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ সিনেমায়। শুধু তাই না, হাস্যরসের এই সিনেমার শেষদিকে তিনি উপহার দেন এক মর্মস্পর্শী ভাষণ। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা এই ভাষণে হিটলারের ঘৃণা ছড়ানো আর জাতপাতের শ্রেষ্ঠত্বের বিপরীতে চ্যাপলিন ছড়িয়ে দেন সাম্যর বাণী। 

 

 

  

 

"মুশফিকের অবসরের খবরে ক্রিকেটভক্তরা" । মিমের জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ বিশেষ কোন কারিগরি দক্ষতা ছাড়াই একজন সৃজনশীল মানুষ মিম তৈরি করতে পারেন। সমকালীন এই মিমটি তৈরি করেছেন সৈয়দ ফয়েজ আহমেদ

 

 

এই যে হিটলারকে কটাক্ষ করার ব্যাপারটা, এর চেয়ে কার্যকর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড খুব কমই আছে। মাও জে দং বলতেন, “তোমাদের শত্রুপক্ষকে হাস্যকর করে তোলো, তবে রাজনৈতিক লড়াইয়ে তোমার জয় হবে, মাওয়ের এই বাণী নাকি হীরক রাজার দেশে সিনেমার শুটিং এর সময় সত্যজিৎ বলতেন সিনেমাটির মূল চরিত্র উৎপল দত্তকে। ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ এর মতো ‘হীরক রাজার দেশে’র বিপুল প্রভাব বাংলাভাষাভাষীরা টের পায়। এরও কয়েক শতক আগে, ১৭৬৭ সালের ১৬ মে, দার্শনিক বন্ধু এতিয়েন নোয়েল দামিলাভিলকে লেখা এক চিঠিতে ভলতেয়ার বলেন, “ আমি খোদার কাছে কিচ্ছু চাই নাই, শুধু একটা জিনিস ছাড়া, ওহ প্রভু, আমার শত্রুদের তুমি হাস্যকর বানিয়ে দাও। পরম করুণাময় আমার সেই আর্জি মঞ্জুর করেছেন।”

 

হাসিঠাট্টা দিয়ে এইভাবে জনমানস গঠন করার ব্যাপারটা অবশ্য বহু পুরনো। বলাই বাহুল্য, কেবলমাত্র ‘শুভ রাজনীতি’ চর্চাতেই এর ব্যবহার ছিল তাই না, ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়াতেও এর জুড়ি মেলা ভার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইতালির শহর মাসা মারিত্তিমায় ত্রয়োদশ শতকে আকা ‘পেনিস ট্রি’ নামক একটি মুর‍্যাল। তাসকানি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বহু মুর‍্যালের মতো একেও প্রথম দেখায় আরো একটা গড়পড়তা মধ্যযুগীয় ফ্রেস্কো ভাবলেও  গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, এর পেছনে বড়সড় একটা রাজনীতি আছে। এই মুর‌্যালে দেখা যায় একটা কিম্ভুত গাছে ২৫টা নানা আকার ও আকৃতির পুরুষাঙ্গ ঝুলে আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি একটি পরিষ্কার রাজনৈতিক বার্তা, যাতে গুলেফ গোত্রের লোকদের বলা হচ্ছে যে, যদি ঘিবেলিনরা ক্ষমতায় আসে তবে তারা অধর্ম, অশ্লীল যৌনতা, অসভ্যতা এবং শয়তানি জাদুমন্ত্র দিয়ে সব নষ্ট করে দিবে। এইভাবে করে যৌনতা আর অধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে প্রতিপক্ষকে ‘নীতিহীন’ হিসেবে দেখানো একটা সর্বজনীন অনুশীলন। এমনকি প্রাচীন গ্রীস নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলেন, সে যুগে গ্রিক শহরগুলোর দেয়ালজুড়ে বিখ্যাত লোকদের ক্যারিকেচার এবং যৌনাঙ্গের ছবি আঁকা থাকত। একে বলা যেতে পারে, আধুনিক যুগের ‘চিকা মারা’ ও গ্রাফিতির পূর্বসূরি মাত্র।

  

অর্থাৎ, তামাশা ও শিল্পের মিশ্রণ, প্রতিপক্ষকে হাস্যকর বানিয়ে রাজনৈতিক বিজয় লাভের চেষ্টাটা মানুষের ইতিহাসে সবসময়েই ছিল। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষণীয়  যে, সিনেমা, আর্ট বা সাহিত্যর মতো এই ব্যাপারগুলো করতে হতো বিশেষায়িত দক্ষতার মাধ্যমে। এমনকি চিকা মারার মতো আপাত ‘অশৈল্পিক’ ব্যাপারেও দক্ষতা লাগে। আমজনতার এইসব তামাশার গ্রাহক হলেও সৃষ্টির ব্যাপারে বাধা ছিলই। আর তাছাড়া, দেয়ালচিত্র যেমন স্থানিক, তেমনি সিনেমা বা লিটারেচার আসলে সবসময়েই একটা বিশেষ শ্রেণির মানুষের দখলে। এই ব্যাপারেই একটা বড়সড় পরিবর্তন বা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে মিম। ডিজিটাল যোগাযোগের সহজলভ্যতা আর বিস্তারকে কাজে লাগিয়ে মিম হয়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক এক হাতিয়ার। 

 

 

সিনেমা, আর্ট বা সাহিত্যর মতো এই ব্যাপারগুলো করতে হতো বিশেষায়িত দক্ষতার মাধ্যমে। এমনকি চিকা মারার মতো আপাত ‘অশৈল্পিক’ ব্যাপারেও দক্ষতা লাগে। আমজনতার এইসব তামাশার গ্রাহক হলেও সৃষ্টির ব্যাপারে বাধা ছিলই। আর তাছাড়া, দেয়ালচিত্র যেমন স্থানিক, তেমনি সিনেমা বা লিটারেচার আসলে সবসময়েই একটা বিশেষ শ্রেণির মানুষের দখলে। এই ব্যাপারেই একটা বড়সড় পরিবর্তন বা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে মিম।

  

 

ডিজিটাল সামাজিকমাধ্যম চরিত্রগতভাবে গণতান্ত্রিক, এইখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং ভুরুঙ্গামারী বা রাউজানের যে কারও একই রকম একসেস আছে এবং অন্তত তাত্ত্বিকভাবে, দ্বিতীয় ব্যক্তিটি ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামে সমান রকম প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। আর সোস্যাল মিডিয়ার অন্যতম ভাষা বা হাতিয়ার মিম এই স্থলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। 

  

‘মিম’ শব্দটা এসেছে গ্রিক শব্দ ‘মিমেমা’ থেকে, যার অর্থ এমন কিছু যাকে অনুকরণ করা হয়। চার্লস ডারউইন এর সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে নাম দেন ‘জিন’। জিন জিনিসটা প্রজন্মে থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে টিকে থাকে। ডারউইনের বহুকাল পরে ১৯৭৬ সালে আরেক বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার ‘সেলফিশ জিন’ বইয়ে প্রথম ‘মিম’ শব্দ উল্লেখ করেন। এর মাধ্যমে তিনি বলেন, মিম হচ্ছে এমন একটি ধারনা, আচরণ, অথবা শৈলী যা অনুকরণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে পড়াতে সামাজিক রীতিনীতি, পরিবেশ, ঐতিহ্য ইত্যাদি ভূমিকা রাখে। আর, যেসব মিম উপযুক্ত পরিবেশ পায় তারাই ছড়িয়ে পড়ে ও টিকে থাকে। অর্থাৎ, ডকিন্স জীবের যে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বিবর্তন হয় সেটির ব্যাখ্যা দিতে ‘মিম’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তবে, কয়েক দশক পরেই মিম বিষয়টা ইন্টারনেটের আচরণ বোঝাতে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হয়ে ওঠে। কারণ ইন্টারনেট মিমের বিবর্তন, টিকে থাকা ও প্রসারের জন্য আদর্শ মাধ্যম। উল্লেখ্য, ডকিন্স নির্ধারণ করেন যে, ‘ক্রিম’ এর উচ্চারণের মতো এর উচ্চারণ হবে ‘মিম’। 

 

 

যেসব মিম উপযুক্ত পরিবেশ পায় তারাই ছড়িয়ে পড়ে ও টিকে থাকে। অর্থাৎ, ডকিন্স জীবের যে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বিবর্তন হয় সেটির ব্যাখ্যা দিতে ‘মিম’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তবে, কয়েক দশক পরেই মিম বিষয়টা ইন্টারনেটের আচরণ বোঝাতে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হয়ে ওঠে। কারণ ইন্টারনেট মিমের বিবর্তন, টিকে থাকা ও প্রসারের জন্য আদর্শ মাধ্যম।

 

  

মিম বিশেষজ্ঞদ্বয় নোবেল ও ল্যাংকাশায়েরের (২০০৭) মতে, ইন্টারনেট ব্যাবহারকারীরা ‘মিম’ শব্দটা ইউজ করেন এমন কিছু বুঝাতে, যাতে কোনো ‘নির্দিষ্ট ধারণা’ একটা টেক্সট, ইমেজ, ল্যাংগুয়েজ ‘মুভ’ অথবা অন্য কোনো ধরনের কৌশলে ছড়িয়ে যায় । আরো একজন বিশ্বখ্যাত মিম বিশেষজ্ঞ, লিমোর শিফম্যান (২০১৩) বলেন, ‘ইন্টারনেটে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে তামাশা, গুজব, ভিডিও, ছবি, টেক্সট ছড়িয়ে যায়, আর এই উপাদানগুলোকেই আমরা ‘মিম’ বলতে পারি। আর ‘মিম’ যখন অনেকটা স্পেসজুড়ে অর্থাৎ অনেকের কাছে পৌঁছে যায়, একে আমরা ‘ভাইরাল কনটেন্ট’ বলতে পারি। অবশ্য ভাইরাল ব্যাপারটা আলাদা একটা সত্তা, মিম বাদে অন্য যে কোনো কিছুই, যেমন কোনো ওয়েব সাইটের সংবাদ, কোনো নির্দিষ্ট ছবি ইত্যাদি। 

 

 

মতি মিয়া বাংলা মিমের একটি জনপ্রিয় উপকরণ। মতি মিয়াকে উপজীব্য করে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশীদের টাকা পাচার বিষয়ে

সুইস রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্ক নিয়ে সমকলীন এই মিমটি তৈরি করেছেন পুন্নি কবীর  

 

  

সংক্ষেপে মিমের সংজ্ঞা ও বিকাশ আলোচনার পর দেখা যাক ভাইরাল হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো কী কী? মিম নিয়ে কাজ করা অ্যাকাডেমিকরা নানারকম উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ছয়টি শব্দকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেন যে শব্দগুলোর আদ্যক্ষর ‘পি’। এগুলো হলো পার্টিসিপেশন, পজিটিভিটি, প্রভোকেশন, প্যাকেজিং, প্রেস্টিজ ও পজিশনিং। প্রথমত, পার্টিসিপেশন। লাখ লাখ মিম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, আমজনতার তৈরি করা কনটেন্টগুলো, পরিকল্পনা করে, দামি সেট সাজিয়ে করা শ্যুটিং থেকে বেশিরকম সাড়া পায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ব্যাপারটা আসে ইন্টারনেটকে মূলত একটি কমিউনিটি বা পিআর কানেকশনের জায়গা হিসেবে বিবেচনা করার ফলে। এখনকার দিনে ভার্চ্যুয়াল স্পেস প্রথাগত সামাজিকীকরণের স্থান নিয়ে নেওয়াই এর কারণ। আর ইন্টারনেট ব্যাপারটা সংজ্ঞানুসারে গ্লোবাল হলেও, এর মধ্যে অদ্ভুতভাবে এই আলাদা আলাদা কমিউনিটি বা বাবল তৈরি হয়।

 

 

লাখ লাখ মিম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, আমজনতার তৈরি করা কনটেন্টগুলো, পরিকল্পনা করে, দামি সেট সাজিয়ে করা শ্যুটিং থেকে বেশিরকম সাড়া পায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ব্যাপারটা আসে ইন্টারনেটকে মূলত একটি কমিউনিটি বা পিআর কানেকশনের জায়গা হিসেবে বিবেচনা করার ফলে। এখনকার দিনে ভার্চ্যুয়াল স্পেস প্রথাগত সামাজিকীকরণের স্থান নিয়ে নেওয়াই এর কারণ। আর ইন্টারনেট ব্যাপারটা সংজ্ঞানুসারে গ্লোবাল হলেও, এর মধ্যে অদ্ভুতভাবে এই আলাদা আলাদা কমিউনিটি বা বাবল তৈরি হয়।

 

 

পজিটিভিটি বিষয়টার সঙ্গে হিউমার জুড়ে দেওয়া জরুরি। মানুষের জীবনে রসিকতা ও খেলাধুলা অত্যন্ত জরুরি। ক্রীড়া-নৃতত্ত্বের অন্যতম সেরা বই ‘হোমো লুডেনস’-এ জোহান হুইজিংগা বলেন যে, “খেলা হচ্ছে একটি মুক্ত-প্রান্তীয় কার্যক্রম, যাতে মানুষ বাস্তব জগতের বাইরে এসে ‘সাময়িক এক জগতে নিজেকে আত্মীকরণ করে নেয়। হুইজিংগার এই আলাপ ইন্টারনেট জগৎ সম্বন্ধেও ভীষণভাবে খাটে। আর হাস্যরস থাকলে মিম জনপ্রিয় হয় এটা একেবারেই স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু, কেবল হাস্যরস থাকলেই হয় না, সহজবোধ্যতা আরেকটি জরুরি বিষয়। সেটাকে সহজেই পুনরাবৃত্তি করতে পারাও জরুরি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো বিষয়বস্তুটাকে উদ্ভট হতে হবে। 

  

জিন বা মিমের আরেকটি উল্লেখযোগ্য মিল লক্ষ্যণীয়। জিন যখন কপি বা প্রতিলিপি তৈরি করে তখন কোটি কোটির মধ্যে একটা দুইটা ‘ভুল’ কপি হয়, সোর্স জিনের থেকে অতি সামান্য হেরফের হয়। তবে এই সামান্য হেরফেরই মানুষের চেহারা, আচরণ থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই বিপুল পার্থক্য হয়। এই ‘ভুল’ আদতে তাই জিনের টিকে থাকার সময় বাড়িয়ে দেয়। একই ব্যাপার ঘটে মিমের বেলায়। অরিজিনাল কনটেন্ট ইউজাররা নিজের মতো পরিবর্তন করে নেয়। সত্যি বলতে কী, মিম মানেই তাই। 

  

উদাহরণস্বরুপ ধরা যাক, হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটকের দুই চরিত্রের একজন সংলাপ দিচ্ছেন- “গাঞ্জা খাইয়াই কুল পাইনা, পড়ালেখা করবো কখন”- এই লাইনটা নানাসময়ে নানারকম সেটাপে ব্যবহার করা হয়। তেলবাজ মিডিয়াকে কটাক্ষ করে কেউ একজন হয়তো ঐ চরিত্রদুটোর ছবি দিয়ে টেক্সটটাকে বদলিয়ে বলছেন- “তেল মাইরাই কুল পাইনা সাংবাদিকতা করবো কখন।”, কিংবা কোনো খেলোয়াড়ের পারফরমেন্সে ক্ষিপ্ত হয়ে কেউ মিম বানিয়ে ফেলল – “বিজ্ঞাপন কইরাই কুল পাইনা প্র্যাকটিস করবো কখন”, কিংবা “দুর্নীতিবাজ অফিসারের ছবি বসিয়ে বলল-“ঘুষ খাইয়াই কুল পাইনা, জনগণের সেবা করবো কখন।” অর্থাৎ, এই একটা ছবিকে ব্যবহার করে অসীম সংখ্যাক টেক্সট উৎপাদন করা যায়, যেগুলো মিমে পরিণত হয়ে ইন্টারনেট জুড়ে ছড়িয়ে যেতে পারে। বিষয়টার সঙ্গে জিআইএফ, ভিডিও ইত্যাদি যুক্ত করে এর সম্ভাবনাকে আরো বিস্তার করানো যায়। অর্থাৎ, একটা জিনিসের ‘ইচ্ছাকৃত ইমপারফ্যাক্ট কপি’ মিম উৎপাদনের প্রধানতম অনুষঙ্গ। 

 

 

হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটকের দুই চরিত্রের একজন সংলাপ দিচ্ছেন- “গাঞ্জা খাইয়াই কুল পাইনা, পড়ালেখা করবো কখন”- এই লাইনটা নানাসময়ে নানারকম সেটাপে ব্যবহার করা হয়। তেলবাজ মিডিয়াকে কটাক্ষ করে কেউ একজন হয়তো ঐ চরিত্রদুটোর ছবি দিয়ে টেক্সটটাকে বদলিয়ে বলছেন- “তেল মাইরাই কুল পাইনা সাংবাদিকতা করবো কখন।”, কিংবা কোনো খেলোয়াড়ের পারফরমেন্সে ক্ষিপ্ত হয়ে কেউ মিম বানিয়ে ফেলল – “বিজ্ঞাপন কইরাই কুল পাইনা প্র্যাকটিস করবো কখন”, কিংবা “দুর্নীতিবাজ অফিসারের ছবি বসিয়ে বলল-“ঘুষ খাইয়াই কুল পাইনা, জনগণের সেবা করবো কখন।” অর্থাৎ, এই একটা ছবিকে ব্যবহার করে অসীম সংখ্যাক টেক্সট উৎপাদন করা যায়, যেগুলো মিমে পরিণত হয়ে ইন্টারনেট জুড়ে ছড়িয়ে যেতে পারে।

 

  

ইন্টারনেট, বিশেষত ফেসবুকের মতো মাধ্যম একইসঙ্গে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক। এখানে ব্যক্তি নিজেকে নানাভাবে প্রকাশ করার জন্য একটা একান্ত স্থান পান, যেটা তিনি নিজেই নিয়ন্ত্রণ করেন আবার একইসঙ্গে তিনি বাকি নেটিজেনদের সঙ্গেও যুক্ত হতে চান। একজন ব্যক্তি একইসঙ্গে নিজের সৃষ্টিশীলতা দেখাতে চান আবার চান গোটা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত থাকতে। যেমনটা সমাজবিজ্ঞানী রোজারিও কন্টে বলেন যে, “ব্যক্তি কেবল তার সংস্কৃতির ধারক হয়েই থাকতে চান না, এতে তিনি সক্রিয় ভূমিকাও রাখতে চান।”  মিম সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য যুৎসই পাটাতন তৈরি করে দেয়, কারণ মিম অসম্পূর্ণ ও উন্মুক্ত।

 

শিল্পকলার মতো এর অলঙ্ঘনীয় ব্যাপার নেই, বরং প্রতিটা মিম এক অর্থে প্রতিটি গ্রাহককে আমন্ত্রণ জানায় একে পরিবর্তনের, পরিবর্ধনের। মিমের রিসিভার এর ফলে নিজেকে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন, এই ভাবনা থেকেই তিনি নতুন মিম বানান, এভাবেই মিম নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে। মিমের এই শক্তি মিমকে দারুন কার্যকরী হাতিয়ারে পরিণত করে। এখানে আরেকটা কথা উল্লেখ না করলেই না, ভালো সাহিত্য বা ভালো ফিল্মের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে নানা স্তরে পাঠককে আমোদিত করে। জ্ঞানের ও অভিজ্ঞতার নানা স্তরে থাকা পাঠক ভিন্ন ভিন্ন পরতের আনন্দ লাভ করে। কেউ হয়তো শুধু সিনেমার কাহিনীতেই বিমোহিত, কেউ আবার ডিটেইল এক্সপার্ট এনালাইসিস করেন, কেউ আরো একধাপ এগিয়ে, সোশিওইকোনোমিক পারস্পেকটিভও বুঝতে চান ঐ লেন্সেই। ফুটবল খেলার ক্ষেত্রেও তাই হয়, কেউ হয়তো শুধু গোল দেখেই খুশি, কেউ জটিল ফরমেশন, কেউ এর ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব। মিমও এই ক্লাসিক ‘এন্টারটেইনমেন্ট টুলগুলো’র মতো। মিমকে নানা পরতে উপভোগ ও বিশ্লেষণ করা যায়। এর গুরুত্বও ‘তামাশা’ ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত।  

  

সেই সঙ্গে আরো যে বিষয়গুলো মাথায় রাখা জরুরি যে, এটেনশন ইকোনমি এখনকার দিনের গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার, ফলে মিম যেমন ব্যক্তির প্রকাশের পাটাতন, আবার একে ব্যবহার করে নানারকম ফায়দা লোটাও সম্ভব। বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানেরা এই চেষ্টাটা করে যাচ্ছে। আবার ফলত এইখানে একটা ইঁদুর বেড়াল খেলা চলে, ভোক্তা হয়ে উঠা বনাম, কনজুমারিজমকে কটাক্ষ করার খেলা। 

  

আলাপটাকে আবার রাজনৈতিক মিমে নিয়ে যাই। শিফম্যান (২০১৪) বলেন যে, রাজনৈতিক মিমের উদ্দেশ্যে হচ্ছে একটা মতামত তুলে ধরার মাধ্যমে আলোচনা ও বিতর্কের ক্ষেত্র তৈরি করা, যার মাধ্যমে মিম উৎপাদনকারী নিজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিভিন্ন বিষয়কে কীভাবে সমাজে দেখা হবে সেই ধারনাগুলোর উপর প্রভাব রাখার চেষ্টা করেন। তিনি আরো বলেন, ইন্টারনেট মিম হচ্ছে আধুনিক লোকসাহিত্য, যাতে ফটোশপ ইমেজ, টেক্সট এডিশন বা নানা কৌশলে বিভিন্ন মতামত ও মূল্যবোধ তুলে ধরে হয়। ঠিক যেন আগের দিনের লোকগাঁথা, প্রবাদ প্রবচনের মতো। 

  

সমাজবিজ্ঞানী রস ও রিভার্স (২০১৭) তে তাই বলেন, মিমের সেইসব বৈশিষ্ট্য আছে যার মাধ্যমে নাগরিক ‘প্রাকৃতিক’ উপায়ে প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিষয়াবলী নিয়ে নিজেদের মতামত দিতে পারে কোনোরকম দেরি হবার ভয় কিংবা মূলধারার মিডিয়ার সেন্সরশিপের ভয় ছাড়াই। মিম তাই রাজনৈতিক হাতিয়ার শুধু না, জনতার প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম। 

  

সেই ১৯৫০ এর দিকে সমাজবিজ্ঞানী আরভিনং গফম্যান উল্লেখ করেন যে, রাজনীতিতে ‘ফ্রন্টস্টেজ’ আর ‘ব্যাকস্টেজ’ আছে। রাস্তার রাজনীতি হচ্ছে ফ্রন্টস্টেজ কিন্তু একে গড়ে দেয়ার পেছনে প্রতিনিয়ত জনমত গঠনের যে কাজ করতে হয় সেই ব্যাকস্টেজ কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পরের যুগগুলোতে এর গুরুত্ব বোঝা যায়, চমস্কির ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ এর আলোচনায় , আরো সাম্প্রতিক সময়ে সুশানা যুবফরা উচ্চকিত হচ্ছেন সার্ভিলেন্স ক্যাপিটালিজম নিয়ে। মিমকে ব্যবহার করে এই বিপুল শক্তিগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ানো যায়। বলা চলে পূর্বোক্ত সেই ইঁদুর বেড়াল খেলার মতোই। 

  

এইসব আলোচনার পটভূমিকায় মিম অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীনরা যতো বেশি প্রোপাগান্ডা মেশিনগুলো শক্তিশালী করছে, এর বিপরীতে মিমসহ অন্যান্য কৌশলও শক্তিশালী হচ্ছে। মিমের গণতান্ত্রিক শক্তি আরো বিকশিত হচ্ছে নিত্যনতুন কৌশলে। 

  

রাজনীতিতে মিমের সম্ভবত প্রথম বড় প্রভাব দেখা যায় ২০০৮ সালের বারাক ওবামার নির্বাচনের সময়। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনে এর বিপুল উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। আবার একই সঙ্গে সেই আন্দোলনের উই আর ৯৯% এর বিপরীতে রক্ষণশীলেরা উই আর ৫৩% আন্দোলন করে, যাতে অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, ডানপন্থীরা খড়গহস্ত হয় বিভিন্ন রকম সোস্যাল ওয়েলফার স্কিমের বিপরীতে। সেখানেও মিম বড় ভূমিকা রাখে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের নির্বাচনী কৌশলে মিমকে ব্যাবহার করেন।   

  

রাশিয়াতে ভ্লাদিমির পুতিনের স্বৈরাচারী শাসনে বিরোধী দলকে হিমশিম খেতে হলেও মিম কালচার সেখানে বিরোধী রাজনীতির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে দাড়িয়েছে। রুশ অ্যাকাডেমিক আনাসতাসিয়া দেনিসোভা তার ‘ইন্টারনেট মিমস অ্যান্ড সোসাইটি’ বইতে উল্লেখ করেন কীভাবে পুতিনের শাসনামলে মিম হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অসন্তোষ ও প্রতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একই ব্যাপার চীনের বেলাতেও খাটে। 

  

আমাদের এই তল্লাটে আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশের মিম ‘খেলা হবে’ কলকাতার নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। 

  

তবে, মিমের সবচেয়ে দুর্দান্ত ব্যবহার দেখা যায়, ব্রাজিলের বলসেনারোর বেলায়। এই রক্ষণশীল নেতা ব্রাজিলের রাজনীতিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায় ছিলেন না, তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি চমক দেখিয়ে জয়লাভ করেন। বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা জেলে অন্তরীন থাকায় কিংবা নানারকম দুর্নীতির দায়ে তাদের প্রতি জনতার আস্থা যখন তলানীতে, তখনই বোলসেনারো হাজির হন নিজের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি নিয়ে। ‘ক্লিন ইমেজ’ তৈরি করতে তিনি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন সোস্যাল মিডিয়া ও মিম। প্রাক্তন এই সামরিক কর্মকর্তা, অতীতের আরো অনেক স্বৈরশাসকের মতো ‘ভালো মানুষের’ দারুণ প্রতিমূর্তি গঠন করেন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে টালমাটাল দেশটিতে। বলসেনারো মিম, যেগুলো বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে, সেগুলো তার এই গঠনে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল। 

 

 

বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা জেলে অন্তরীন থাকায় কিংবা নানারকম দুর্নীতির দায়ে তাদের প্রতি জনতার আস্থা যখন তলানীতে, তখনই বোলসেনারো হাজির হন নিজের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি নিয়ে। ‘ক্লিন ইমেজ’ তৈরি করতে তিনি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন সোস্যাল মিডিয়া ও মিম। প্রাক্তন এই সামরিক কর্মকর্তা, অতীতের আরো অনেক স্বৈরশাসকের মতো ‘ভালো মানুষের’ দারুণ প্রতিমূর্তি গঠন করেন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে টালমাটাল দেশটিতে।

 

  

একটা কথা উল্লেখ না করলেই না, নিয়মানুসারে ব্রাজিলের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে নির্বাচিত কংগ্রেসম্যানের অনুপাতে একেকজন প্রার্থী ফ্রি সময় বরাদ্দ পান নির্বাচনী প্রচারে। সে অনুসারে সাও পাওলোর প্রাক্তন গভর্নর জেরাল্ডো আলকেমিন যেখানে পান ৫ মিনিট ৩২ সেকেন্ড, সেখানে বলসেনারো পান সাকুল্যে আট সেকেন্ড। 

  

কিন্তু, মিম দিয়ে তিনি পাশার দান উল্টে দেন। সামাজিক মাধ্যমে তার বিপুল উপস্থিতি, প্রথাগত মাধ্যম তথা টেলিভিশন বা সংবাদপত্রে উপস্থিতির চেয়ে অনেক বেশি জরুরি প্রতীয়মান হয়। 

 

বলসেনারোর এই ঘটনা নিশ্চিতভাবেই সামাজিকমাধ্যম এবং মিমের শক্তিকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে। অবধারিতভাবেই মিমের এই শক্তি আরো বৃদ্ধি পাবে। মিমের কৌশল আরো বিকশিত হবে। মিমকে কাজে লাগিয়ে বলসেনারো যেমন ক্ষমতায় এসে আমাজন ধ্বংস করা, আদিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন ও দুর্নীতির মচ্ছব চালাচ্ছেন, এই মিম দিয়েই আগামী দিনের পরিবেশ রক্ষা, সাম্যর রাজনীতি আর মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার লড়াই চালানো হবে এতে কোন সন্দেহ নাই।
 

রাজনীতির তত্ত্বীয় আর ব্যবহারিক প্রয়োগে, মিম আরো অনেকখানি জায়গা দখল করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই দারুণ হাতিয়ারটা কে কীভাবে ব্যবহার করে। 

 

Your Comment