শনিবার ৬ই বৈশাখ ১৪৩১ Saturday 20th April 2024

শনিবার ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

Saturday 20th April 2024

বহুস্বর মতামত

ভাওয়াল শালবন বনাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক

২০২২-০৭-২৪

পাভেল পার্থ

ময়ূর, হরিণ আর বাঘের স্মৃতি

 

ভাওয়াল শালবনকে একসময় বলা হতো ময়ূরবন। গাজীপুরের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এই শালবনের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের ভিটিপাড়া কোচ-বর্মণ গ্রামের যাত্রাদলের মঞ্চকাঁপানো নায়ক দিগেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ (৯০) রাথুরা শালবনে চিতাবাঘ, বুনো শূকর, সজারু, হরিণ, খরগোশ, অজগর ও ময়ূরসহ নানান জাতের পাখি দেখেছেন। বিচিত্রবর্ণের ময়ূর-পালক নিয়ে কেটেছে তাঁদের শৈশবকাল।

 

 

কালিয়াকৈরের রামচন্দ্রপুর গ্রামের প্রবীণ বেলায়েত হোসেন (৭০) ১৯৫৫ সালে বুড়িপাবরচালা থেকে গোলাপি-লাল ময়ূরের ডিম খুঁজে পেয়ে তা মুরগির তায়ে ফুটিয়ে সেই ময়ূর বড় করেছিলেন। তার মতে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শালবনে আর ময়ূর দেখা যায়নি। ১৯৮৫ সালে শেষ ময়ূর দর্শনের কথা শোনা যায়। কালিয়াকৈরের মৌচাক ইউনিয়নে হরিণহাটি নামে একটি গ্রাম আছে। হরিণের জন্যই এই গ্রামের এমন নাম হয়েছিল। কিন্তু এখন এটি ইটপাথরের বিল্ডিং কারখানা বোঝাই এক দমবন্ধ শ্রমিকবস্তি।

 

 

কালিয়াকৈরের রামচন্দ্রপুর গ্রামের প্রবীণ বেলায়েত হোসেন (৭০) ১৯৫৫ সালে বুড়িপাবরচালা থেকে গোলাপি-লাল ময়ূরের ডিম খুঁজে পেয়ে তা মুরগির তায়ে ফুটিয়ে সেই ময়ূর বড় করেছিলেন। তার মতে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শালবনে আর ময়ূর দেখা যায়নি। ১৯৮৫ সালে শেষ ময়ূর দর্শনের কথা শোনা যায়। কালিয়াকৈরের মৌচাক ইউনিয়নে হরিণহাটি নামে একটি গ্রাম আছে। হরিণের জন্যই এই গ্রামের এমন নাম হয়েছিল। কিন্তু এখন এটি ইটপাথরের বিল্ডিং কারখানা বোঝাই এক দমবন্ধ শ্রমিকবস্তি। একসময় শালবন হরিণ ও ময়ূরের পাশাপাশি বাঘশূন্যও হয়ে পড়ে। ১৯৪০ সালে ভাওয়াল শালবনে বাঘের সর্বশেষ বিচরণের কাহিনী জানা যায়। শ্রীপুরের তেলিহাটি ইউনিয়নের গুদারচালা রবিদাসপাড়ার পত্তন করেন শুকলাল মুচি। তিনি বাঘের বাচ্চা পালতেন, যাদের তিনি রাথুরা বনের ভেতর খুঁজে পেয়েছিলেন। বাঘের স্মৃতি নিয়ে ভাওয়াল শালবনে এখনও টিকে আছে বাঘের বাজার, বাঘেরচালা, বাঘেরবাইদ, বাঘাডোবা এলাকাগুলি।

 

 

গাজীপুরের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছিল এই শালবন

 

 

ময়ূর বা বাঘ না থাকলেও বাঘের বাজার এলাকার রাথুরা শালবনে প্রশ্নহীনভাবে শুরু হওয়া এশিয়ার বৃহত্তম সাফারি পার্কের জন্য আনা হয়েছে বাঘ, সিংহ, জিরাফ, হাঁস, কচ্ছপসহ নানান দেশ-বিদেশের বন্যপ্রাণী। ইতোমধ্যেই সাফারিপার্কের জন্য আনা বাঘের আক্রমণে বনরক্ষী বিষ্ণু চন্দ্র বর্মণ গুরুতর আহত হন (সূত্র: http://bd24live.com, ৩১ অক্টোবর ২০১৩)।

 

 

এশিয়ার বৃহত্তম সাফারি পার্ক : “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক”

 

বাংলাদেশ বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক বনভূমিতে নানান ধরণের সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। যেমন সংরক্ষিত বন, অভয়ারণ্য, গেম রিজার্ভ, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা, সাফারি পার্ক, জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২’র ২৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, সরকার বন্যপ্রাণী সম্পদ তাহার নিজ আবাসস্থলে (ইন-সিটু) বা আবাসস্থলের বাহিরে অন্যত্র (এক্স-সিটু) সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এবং জনসাধারণের গবেষণা, চিত্তবিনোদন এবং শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে যে-কোন সরকারি বনভূমিকে বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে সাফারি পার্ক, ইকোপার্ক, বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র বা উদ্ভিদ উদ্যান ঘোষণা করতে পারবেন।

 

 

যদিও উল্লিখিত আইন চূড়ান্ত হওয়ার আগেই ১৯৯৯-২০০০ সালে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলাধীন ডুলাহাজরায় ২২৩৭.০ একর এলাকা নিয়ে দেশের প্রথম সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭৩ সালে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর ২০১০ সালে একনেক প্রায় ৬৪ কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে গাজীপুরের ভাওয়াল শালবনে দেশের দ্বিতীয় “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক” প্রকল্পটি অনুমোদন করে। বাংলাদেশ বনবিভাগের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি এশিয়ার বৃহত্তম সাফারি পার্ক। “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক প্রকল্প” সূত্র বলছে, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের বড় রাথুরা মৌজা ও সদর উপজেলার পিরুজালি ইউনিয়নের পিরুজালি মৌজার বনভূমির ৩,৬৯০ একর ভূমি সাফারি পার্কের মহাপরিকল্পনার অংশ।

 

 

রাথুরা শালবনসহ আশেপাশের স্থানীয় জনগণের তীব্র আপত্তি ও উত্থাপিত প্রশ্নসমূহকে পাত্তা না দিয়ে ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী (বর্তমানে তথ্যমন্ত্রী) হাছান মাহমুদ বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। উদ্বোধনের পর ২০১১ সালের ৪ অক্টোবর বর্ধিত আকারে উক্ত প্রকল্পের বাজেট হিসেবে ২২০ কোটি টাকা অনুমোদন দেয় একনেক। সাফারি পার্কের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে বন বিভাগ ইতোমধ্যেই ১৭০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। বিদেশ থেকে বন্যপ্রাণী আমদানি ও স্থাপনা নির্মাণে ব্যয় করেছে ৩০ কোটি টাকা। সাফারি পার্কের জিরাফ কেন্দ্র, হ্যালিপ্যাড, ইকো রিসোর্ট ও রাস্তাঘাট তৈরির জন্য সংরক্ষিত শালবনের অনেক শালগাছ কেটে এই উন্নয়ন কর্মসূচি শেষ করছে বনবিভাগ (সূত্র: শালবন কেটে সাফারি পার্ক, দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩)।

 

 

ভাওয়ালের কৃষি ইতিহাস অস্বীকার

 

মধুপুর ও ভাওয়ালগড়ের ভূমির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো স্থানীয়ভাবে এখানে উঁচু জমিকে ‘চালা’ ও নিচু জমিকে ’বাইদ’ বলে। বাইদ জমিগুলোই বনের আশেপাশের জনগণের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম সূত্র। স্থানীয়ভাবে এই কৃষি জমিগুলো শাইল ধানের জমি বা শাইল জমি হিসেবে পরিচিত। ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের জন্য গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৩০০ পরিবারকে বড় রাথুরা মৌজার সর্বমোট ৩৬৩.১৭ একর শাইল জমি অধিগ্রহণের নোটিশ দেয়া হয়।

 

 

বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের জন্য ভেরামতলী বর্মণ গ্রামের রবীন্দ্র বর্মণদের পরিবারকে পরিবারটির ৩ একর ৬ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের নোটিশ পাঠায় রাষ্ট্র। একই গ্রামের রাধানাথ বর্মণ ১.৮৬ একর, সুরেন্দ্র বর্মণ ২.৬ একর, আশুতোষ বর্মণ ২.২ একর, গোপাল চন্দ্র বর্মণ ৩ একর, লোকনাথ বর্মণ ৩ একর, রবীন্দ্র বর্মণ ১.৪৬ একর, হাজী নজরুল হক ৬.৫৩ একর, ইন্তাস আলী সরকার ৫.৩০ একর এবং শিরাসপুরের সলেন বর্মণ এবং বীরেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ ১.২৬ একর জমি অধিগ্রহণের নোটিশ পান। ভেরামতলী গ্রামের আদিবাসীদের ১৮ একর ৯৮ শতক জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সবই নথিভুক্ত দোফসলী শাইল ধানের কৃষি জমি। ভেরামতলীর পাশাপাশি শিরাসপুর, জয়নাতলী, পিরুজালী, ইন্দ্রপুর, বারডোবা ও কব্বরগাছা গ্রামেও অধিগ্রহণ নোটিশ পাঠানো হয়।

 

 

অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত জমিগুলোকে সরকারি নোটিশে ‘শাইল জমি’ বলে উল্লেখ করা হলেও তথাকথিত “এশিয়ার বৃহত্তম সাফারি পার্ক প্রকল্প” এর জন্য অধিগ্রহণকৃত জমিকে স্থানীয় জনগণের টিকে থাকার জীবনধারা হিসেবে পাঠ করেনি বন বিভাগ। পঙ্খীরাজ নামের পাখনাওয়ালা লাল রঙের এক অবিস্মরণীয় শাইল ধান রাথুরা শালবনের বাইদ জমিনের গর্ব।

 

 

বিন্নি, কাইকা, চিনিগুড়ি, কালিজিরা, কুমলি, নোহা, রাজাশাইল, মালতী, ক্ষীনই, আবছায়া, নতিফশাইল এগুলোই প্রায় সবই শাইল ধান। বনকোষ, তেতুলিয়া, পোড়াবিন্নি, কাইস্যাবিন্নি, করাচি, লোহাটাং, কুমড়ি, মালতি, চিনিগুড়া, কালিজিরা, গুদধইয়ের মতো সুগন্ধি ধানের আবাদ হতো চালা ও বাইদ জমিনে। চালা জমিনে বিন্নি আর বাইদ জমিনে শাইল। চালার ধান কাতিশাইল, বিরণ, ভাদুরিয়া, কালাহাইটা, বৈরাগিহাইটা, বৈলান, খুদবৈলান, বড়বৈলান, কটকতারা, চাকুলা, মাধবজটা, ইঞ্চুরি, দাইরল।

 

 

এরকম অজস্র ধানের স্মৃতি ও আখ্যান বয়ে নিয়ে চলা শালবনের উপর হঠাৎ এক জবরদস্তিমূলক প্রকল্প স্থানীয় জনগণের কৃষিজীবনের ইতিহাসকে রীতিমতো অন্যায়ভাবে অস্বীকার করেছে। তাই প্রকল্পটির শুরু থেকেই স্থানীয় জনগণ এর বিরোধিতা করে আসছেন। ফলে বন বিভাগের সাথে তাদের বিবাদ তৈরি হয়েছে। অধিগ্রহণ নোটিশ পাওয়া হাজার হাজার মানুষ ২০১১ সালের ৩ মার্চ গাজীপুরের শ্রীপুরের পিরুজালী-বাবুরচালাতে সাফারি পার্কের বিরুদ্ধে গণসমাবেশ করেন।

 

 

এরকম অজস্র ধানের স্মৃতি ও আখ্যান বয়ে নিয়ে চলা শালবনের উপর হঠাৎ এক জবরদস্তিমূলক প্রকল্প স্থানীয় জনগণের কৃষিজীবনের ইতিহাসকে রীতিমতো অন্যায়ভাবে অস্বীকার করেছে। তাই প্রকল্পটির শুরু থেকেই স্থানীয় জনগণ এর বিরোধিতা করে আসছেন। ফলে বন বিভাগের সাথে তাদের বিবাদ তৈরি হয়েছে। অধিগ্রহণ নোটিশ পাওয়া হাজার হাজার মানুষ ২০১১ সালের ৩ মার্চ গাজীপুরের শ্রীপুরের পিরুজালী-বাবুরচালাতে সাফারি পার্কের বিরুদ্ধে গণসমাবেশ করেন।

 

 

ভাওয়াল শালবনের প্রাণ ও প্রকৃতি

 

ভাওয়াল শালবনে ২২০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫ প্রজাতির পাখি টিকে আছে (সূত্র: http://www.bangladesh.com/national-parks/bhawal/)। অন্য এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২৪ প্রজাতির লতা, ২৭ তৃণ, ৩টি পাম, ১০৫ প্রজাতির গুল্ম, ১৯ প্রজাতির ছোট উদ্ভিদ ও ৪৩ প্রজাতির বৃক্ষসহ মোট ২২১ প্রজাতির উদ্ভিদ ভাওয়াল শালবনে রয়েছে (সূত্র: Our nature(2005) 3:83-90)। নুহ আলম ও এম এ গফুর ভাওয়াল গড়ের চন্দ্রা শালবন থেকে মোট ১২ প্রজাতির লাইকেন শনাক্ত করেন (সূত্র: Bangladesh J. Bot. 37(1): 61-65)। শাল, গাদিলা, কুম্ভি, আজুলি, আনই, বংকুই, কুলবড়ই, বনবড়ই, মনকাঁটা, বনবাঁশ, জয়না, বট, বিলাইপেঙ্গা, সোনালু, আমলকী, হরিতকী, বহেরা, গন্ধভাদাইল্যা, কুমারীডোগা, নেংগুরালতা, ঝিনইলতা, আলেকলতা, গিলা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে বনের মুমূর্ষু প্রাণ।

 

 

শালবনের ফল আনইগোটা, বেকইগোটা, বুদবড়ই, পলাগোটা, বনখাজুর, তিতিজাম, গোটাজাম, মামালাড়। কেন্দুগোটার কাঁচাফল সিদ্ধ করে মাগুর মাছ দিয়ে রান্না করে খাওয়া হয়। শালবনের শেওড়া গাছে বেশি হয় পদ্মাগুরঞ্চি, যার ডাল পানিতে ভিজিয়ে রেখে রস খেলে পেটের সমস্যা দূর হয়। পাকিস্থান আমলে শালবন থেকে গাদিলা পাতা তুলে বিক্রি করা হতো, ১০ কেজির এক বান্ডিল পাতার দাম তখন ছিল ২৫ থেকে ৫০ টাকা। চালা জমিনে ধান, আদা, হলুদ, তিল, তিসি, কলা, বেগুন, শাকসবজি, কাউন, মাষকলাই, সরিষা, কার্পাস তুলা আবাদ হতো।

 

 

বন আলুর অবিস্মরণীয় আখ্যান

 

ছাড়া ছাড়া হিঙ্গান হিবা থা চৌনা

আঙ্গা বা হিঙ্গান

পিদি বা হিঙ্গান

নুনু বা হিঙ্গান

 

(আদিবাসী কোচ নারীরা শালবনে বন আলু তোলার সময় এরকম গান করে। বাংলায় এর মানে দাঁড়ায়, আয় তোরা কে কে যাবি জঙ্গলে আলু তুলতে/ একটু দাঁড়া, খেয়ে নেই, খন্তাকোদাল সব নিয়ে আয় ...)।

 

রাথুরা শালবন স্থানীয় আদিবাসী বর্মণ, ক্ষত্রিয়, ওঁরাও ও দরিদ্র বাঙালি জনগণের খাদ্য, ঔষধ ও জ্বালানির এক ঐতিহাসিক উৎসস্থল। মূলত শীতকাল বনের আলু তোলার সময়। ফাল্গুন থেকে বৈশাখ পর্যন্ত পেংথা পাওয়া যায়, আশ্বিন থেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত তোলা হয় বাকুয়া-থা। ডইলা-থা, গেচ্ছেক-থা, ছুরা-থা, সুমুয়া-থা বনআলুগুলো আশ্বিন থেকে বৈশাখ পর্যন্ত পাওয়া যায়। পাতাইলা, কুচিঙ্গা, জঙ্গইল্যা, স্বাদ, লাল, ম্যৌ, পেং, ছুরা, দুধ, কাকড়া, বেল আলু।

 

 

শালবনের মাটির বাস্তুতস্ত্র

 

 

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের টেংরা ওঁরাও পাড়ার প্রবীণরা জানান, রাথুরা শালবন থেকে জঙ্গলি-কান্দা (বনআলু) তুলতে দল বেঁধে যেত নারীরা। গেঠি-কান্দা, থুত্থু-কান্দা, গঞ্জা-কান্দা নানান নামের নানান স্বাদের আলু। শালবন জুড়ে ছিল ইমা পুত্তা (উইয়ের ঢিবি)। এসব ঢিবিতে পাওয়া ওসা ও চালকুরসা জাতের বুনো মাশরুম খাওয়া যেত। এককালের সেরা শিকারি বরমী ইউনিয়নের পুষাইদ কোচ গ্রামের বিপিন্দ্র বর্মণদের শৈশব-কৈশোর-যৌবন কেটেছে রাথুরা শাল-অরণ্যে। সাগলেদি ফলের আঠা আর বিষলতের ফলের কষ ব্যবহৃত হত শিকারে। কোচদের ঐতিহ্যবাহী বুড়াঠাকুর উৎসবে কেন্দু গাছের পাতাসহ ডাল লাগে, যা কেবল শালবনেই জন্মে। পূজায় আজুগি গাছের পাতায় ভোগ-নৈবেদ্য সাজাতে হয়।

 

 

হারানো লবলং সাগর

 

নদী বা পুকুরের জল ছাড়া শালবনের আদিবাসীদের অনেক কৃত্য হয় না। কৃষি ও অরণ্যের বিকাশ হয় না।

 

 

শালবনে এখন আর কোনো প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ নাই। সব গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। একটার পর একটা কারখানা আর নামে বেনামে কোম্পানির অত্যাচারে শালবনের অন্যতম নদী শালদহ ও লবলং সাগর মরে গেছে। শোনা যায় বাদশা বদিউজ্জামানের জাহাজ এই লবলং সাগরে ডুবে গেছিল। এ নিয়ে স্থানীয় পুঁথিপালাতে বলা আছে, ডুবল জাহাজ লবলং সাহরে / জামালরূপে পাগল হইয়া / ডুবল জাহাজ লবলং সাগরে। রাথুরা বনের ভেতর বারতুপার পশ্চিমে ফুলানির ছিট একটি পবিত্র এলাকা। এখানেই কালিয়াকৈরের বিখ্যাত সাধক ও পাগলপন্থী কেশব পাগল আধ্যাত্মিকতা লাভ করেন। ভাওয়াল শালবনের এক প্রচলিত কাহিনী রামাদেও। যিনি শালবনকে নিজের কোলে তুলে উড়াল দিতে পারতেন। রাথুরা শালবনের সাথে জড়িয়ে আছে এমনই শত সহস্র আখ্যান ও কাহিনী।

 

 

কিন্তু শালবনে এখন আর কোনো প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ নাই। সব গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। একটার পর একটা কারখানা আর নামে বেনামে কোম্পানির অত্যাচারে শালবনের অন্যতম নদী শালদহ ও লবলং সাগর মরে গেছে। শোনা যায় বাদশা বদিউজ্জামানের জাহাজ এই লবলং সাগরে ডুবে গেছিল। এ নিয়ে স্থানীয় পুঁথিপালাতে বলা আছে, ডুবল জাহাজ লবলং সাহরে / জামালরূপে পাগল হইয়া / ডুবল জাহাজ লবলং সাগরে। রাথুরা বনের ভেতর বারতুপার পশ্চিমে ফুলানির ছিট একটি পবিত্র এলাকা। এখানেই কালিয়াকৈরের বিখ্যাত সাধক ও পাগলপন্থী কেশব পাগল আধ্যাত্মিকতা লাভ করেন। ভাওয়াল শালবনের এক প্রচলিত কাহিনী রামাদেও। যিনি শালবনকে নিজের কোলে তুলে উড়াল দিতে পারতেন। রাথুরা শালবনের সাথে জড়িয়ে আছে এমনই শত সহস্র আখ্যান ও কাহিনী। এসব স্মৃতিময়তাকে অস্বীকার করে কোনোভাবেই কি কেবলমাত্র শহরের ধনীদের জন্য সাফারি পার্কের নামে কোনো বাণিজ্যিক বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত?

 

 

শালবন দখলের রাষ্ট্রীয় বৈধতা

 

রাষ্ট্র কর্তৃক ভাওয়াল শালবনের আদিবাসীদের জমি জবরদখল কোনো নতুন কাহিনী নয়। গাজীপুরের শ্রীপুর রেঞ্জ দীর্ঘদিন শ্রীপুর পৌরসভার লোহাগাছ কোচপাড়ার ২৫১ নং দাগের ২২ বিঘা জমি জবরদখল করে ছিল। অবিরত লড়াই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে কোচরা ২০০৫ সালে এ-জায়গার পুন:দখল পায়। গাজীপুরের পাঁচটি উপজেলার ভেতর কালীগঞ্জ বাদে বাকি সব উপজেলাই কোচপ্রধান অঞ্চল। গাজীপুরের পিঙ্গাইল কোচ গ্রাম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সমরাস্ত্র কারখানা স্থাপনের কারণে, হালডোবা কোচ গ্রাম উচ্ছেদ হয়েছে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাস তৈরির ফলে, আর হাতীয়াব কোচ গ্রাম উচ্ছেদ করে টাঁকশাল তৈরি করা হয়েছে। শফিপুর আনসার অ্যাকাডেমির প্রায় জায়গাই বর্মণ আদিবাসীদের। এক নগেন্দ্র বর্মণই এর জন্য ১৮ বিঘা জমি হারান। জিরানী বাজারে দক্ষিণে যেখানে স্টেডিয়াম করা হয়েছে তাও কোচ-বর্মণদের আদিভূমি।

 

 

রাথুরা শালবনের ভেতর বোম্বিং করা হয়, ফায়ারিং ও বোম্বিং রেঞ্জের ফায়ারিংয়ে ২০১০ সালের ১০ ফেব্রæয়ারি শ্রীপুরের ভেরামতলী-মুন্সীপাড়া গ্রামের হাসান নামের ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর মারা যায়। রাষ্ট্র ভাওয়াল শালবন সুরক্ষায় কোনো ধরনের ন্যায়পরায়ণতা দেখায়নি। বছরের পর বছর ধরে ভাওয়াল শালবনের উপর উন্নয়নের উপর্যুপরি আঘাত আর রক্তপাতের বৈধতা দিয়ে চলেছে রাষ্ট্র। শালবন হত্যার কোনো উন্নয়ন প্রকল্প ও বাণিজ্যিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে পারেনি রাষ্ট্র।

 

 

বরং শালবনের সাথে স্থানীয় বাসিন্দাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে পাশ কাটিয়ে, গরিব আদিবাসী ও বাঙালির জমি অধিগ্রহণ করে তাদের কোনো ধরনের সম্মতি ও পরামর্শ ছাড়াই রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাইছে “এশিয়ার বৃহত্তম সাফারি পার্ক”। এটি অসম্ভব, এটি অন্যায়। কোনোভাবেই স্থানীয় জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণ ও পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরণের উন্নয়ন উদ্যোগ টেকসই হতে পারে না। এর কোনো নজির দুনিয়ায় নেই। শালঅরণ্যে যেহেতু এই সাফারি পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে, তাই এর আশেপাশের আদিবাসী ও স্থানীয় বাঙালিদের অরণ্যবিজ্ঞান ও লোকায়ত বন কারিগরিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে স্থানীয় জনগণের বননির্ভরশীলতাকে স্বীকৃতি দিয়েই এই কর্মসূচিকে এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে তুলে ধরা সম্ভব। এর আর কোনো বিকল্প নেই।

 

 

শালবনের বনতলে আজুগি গাছের ফল। এই ফল পাখি ও বানরের খুব প্রিয়

 

 

সাফারি পার্ক নিয়ে রাষ্ট্রের ভাষ্য

 

সাফারি পার্ক প্রকল্পের শুরুর দিকে গাজীপুর জেলা প্রশাসক গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন,“মূলত নাগরিক ক্লান্তি থেকে মুক্ত হতে বিনোদনের জন্য এ পার্কটি করা হচ্ছে।” ভাওয়াল গড়ের পুরো শালবনভূমিই জবরদখল ও বেদখল হয়েছে। অন্যায়ভাবে অরণ্যভূমি থেকে স্থানীয় কোচ, বর্মণ, মান্দি, রাজবংশী, ও ক্ষত্রিয় আদিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ভাওয়াল শালবনের প্রতিবেশব্যবস্থায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে অরণ্য ও আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে গড়ে তোলা হয়েছে সেনানিবাস, টাঁকশাল, সমরাস্ত্র কারখানা, আনসার একাডেমি ও নামে বেনামে একটির পর একটি কলকারখানা। ভাওয়াল শালঅরণ্যের এ করুণ কাহিনী রাষ্ট্রও অস্বীকার করতে পারেনি।

 

 

 “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক” উদ্বোধনের জন্য ২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর বন সংরক্ষকের দপ্তর থেকে প্রচারিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “ভাওয়াল গড়ের শালবন ঐতিহাসিক ভাবে জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন, শিল্পায়ন, বন ধ্বংস করে কৃষি জমির বিস্তার, আবাসন, জবরদখল ও ভূমি বিরোধের কারণে শাল বনের জীববৈচিত্র্য দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে (সূত্র: পত্র নং- ২২.০১.০০০০.১০১.০০০.০২৩.)।”

 

 

উল্লিখিত সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তি আরো জানায়, “এ সাফারী পার্কটি দক্ষিণ এশিয় মডেলে বিশেষ করে থাইল্যান্ডের Safari World-এর আদলে করা হচ্ছে। জুন/২০১০ সালে ৬৩.৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে কাজ শুরু হয়। ভূমি অধিগ্রহণের কাজে সিংহভাগ টাকা ব্যয় হয়। মাস্টার প্ল্যানের আলোকে ২০১১ সালে সংশোধিত প্রকল্পে ২১৯.৮৯ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়। এ সাফারী পার্কে ১২২৫.০০ একর এলাকা নিয়ে কোর সাফারী (Core Safari), ৫৬৬.০ একর সাফারী কিংডম (Safari Kingdom), ৮২০.০ একরের বায়োডাইভার্সিটি পার্ক (Biodiversity Park), ৭৬৯.০ একরে এক্সটেন্সিভ এশীয়ান সাফারী (Extensive Asian Safari), ও ৩৮.০ একর এলাকায় বঙ্গবন্ধু স্কয়ার স্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বন ও অবমুক্ত বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তার জন্য ২৬ কিঃমিঃ মাস্টার বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। আগত দেশি-বিদেশী পর্যটকগন যাহাতে গাড়ীতে বসে বিচরনরত অবস্থায় বন্যপ্রাণী অবলোকন করতে পারে সেজন্য বাঘ, সিংহ, সাদা সিংহ, ভল্লুক, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, সাম্বার হরিণ, জেব্রা, জিরাফ, ওয়াইল্ডিবিষ্ট, ব্লেসবক উটপাখী প্রভৃতি অবমুক্ত করা হয়েছে।”

 

 

এই সাফারি পার্ক প্রকল্পের শুরুর সময় থেকেই রাথুরা বনাঞ্চলের আদিবাসী বর্মণ, কোচ, মান্দি ও বাঙালিরা প্রাকৃতিক শালবনে কোনো বাণিজ্যিক বিনোদন পার্কের বিরোধিতা করেছিলেন। বনবিভাগ জনমনের এসব প্রশ্ন ও আশঙ্কাকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু দেখা গেল শালবনের নিম্নবর্গের এসব শঙ্কাই সত্যে পরিণত হচ্ছে। ভাওয়াল শালবনের ঐতিহাসিক বাস্তুসংস্থান ও গড়ভূমির প্রতিবেশ ও খাদ্যশৃঙ্খলকে গুরুত্ব না দিয়ে সাফারি পার্কের নামে গড়ে তোলা হচ্ছে বহুজাতিক পুঁজির লাগামহীন ভোগবিলাসিতাকে বৈধকরণের এক কর্পোরেট পর্যটন বাণিজ্য।

 

 

এই সাফারি পার্ক প্রকল্পের শুরুর সময় থেকেই রাথুরা বনাঞ্চলের আদিবাসী বর্মণ, কোচ, মান্দি ও বাঙালিরা প্রাকৃতিক শালবনে কোনো বাণিজ্যিক বিনোদন পার্কের বিরোধিতা করেছিলেন। বনবিভাগ জনমনের এসব প্রশ্ন ও আশঙ্কাকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু দেখা গেল শালবনের নিম্নবর্গের এসব শঙ্কাই সত্যে পরিণত হচ্ছে। ভাওয়াল শালবনের ঐতিহাসিক বাস্তুসংস্থান ও গড়ভূমির প্রতিবেশ ও খাদ্যশৃঙ্খলকে গুরুত্ব না দিয়ে সাফারি পার্কের নামে গড়ে তোলা হচ্ছে বহুজাতিক পুঁজির লাগামহীন ভোগবিলাসিতাকে বৈধকরণের এক কর্পোরেট পর্যটন বাণিজ্য। উক্ত সাফারি পার্ক সম্পর্কে বন সংরক্ষক দপ্তর জানিয়েছে, “বাংলাদেশের বন ও প্রাণীবৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারনা দেয়ার জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রকৃতি বীক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।”

 

 

এছাড়া তথ্য ও শিক্ষাকেন্দ্র, প্রাকৃতিক ইতিহাস যাদুঘর, পার্ক অফিস, বিশ্রামাগার, ডরমেটরি, বন্যপ্রাণী হাসপাতাল, কুমির পার্ক, লিজার্ড পার্ক, ফ্যান্সি ডাক গার্ডেন, ক্রাউন ফিজেন্ট এভিয়ারি, প্যারট এভিয়ারি, ধনেশ পাখিশালা, ম্যাকাউ ল্যান্ড, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, ফোয়ারা, বাঘ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁ, সিংহ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁ ও ফুডকোর্ট প্রভৃতি চালু করা হয়েছে। পর্যটকদের ভ্রমণের সুবিধার্থে ২টি বাস ও ২টি সাফারি জিপের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মেরিন অ্যাকুরিয়াম, অর্কিড হাউজ, প্রজাপতি বাগান, ফ্যান্সি কার্প গার্ডেন, কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্র, ঝুলন্ত সেতু, ইকো রিসোর্ট, হস্তি প্রদর্শনী গ্যালারি (Elephant Show Gallery), পাখি প্রদর্শনী গ্যালারি (Bird Show Gallery), এগ ওয়ার্ল্ড, ও শিশু পার্ক প্রভৃতির নির্মাণ কাজ চলমান আছে।

 

 

উদ্বোধনের পর সাফারি পার্ক সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গাজীপুর সফরকালে গাজীপুরের ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠে আয়োজিত বিশাল জনসভায় মেট্রোরেলসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক” উদ্বোধন করেন।

 


শালবন রক্ষায় নিম্নবর্গের লড়াই

 

রাথুরা শালবনের ঐতিহাসিকতাকে অস্বীকার করে গড়ে তোলা সাফারি পার্কের বিরুদ্ধে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মজবুত প্রতিবেশ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন ভেরামতলী গ্রামের তরুণ আদিবাসী নেতা গোবিন্দ বর্মণ। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, লেখালেখি হয়েছে। নাগরিক সমাজ ও পরিবেশবাদীরা সাফারি পার্ক গড়ে তোলার অস্পষ্ট প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র এসব কোনো জনভাষ্যই আমলে নেয়নি।  ২০১১ সালের ৩ মার্চ অধিগ্রহণ নোটিশ পাওয়া হাজার হাজার মানুষ গাজীপুরের শ্রীপুরের পিরুজালী-বাবুরচালাতে সাফারি পার্কের বিরুদ্ধে গণসমাবেশ করে। স্মরণে রাখা জরুরি ২০০১ সালের ১৫ এপ্রিল সরকার মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড ও মুরইছড়া ইকোপার্ক প্রকল্প উদ্বোধন করলেও প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, শিক্ষা-গবেষণা ও পর্যটনের ক্ষেত্রে উল্লিখিত প্রকল্পগুলির কোনো ভূমিকাও বর্তমানে নেই।

 

 

বনবিভাগ টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনে জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের নামে “মধুপুর ইকোপার্ক” নামের এক অন্যায় প্রকল্প চাপিয়ে দিয়ে স্থানীয় বন ও আদিবাসী জনগণের ঐতিহাসিক সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিল। আদিবাসী জনগণের ইকোপার্ক-বিরোধী দীর্ঘ লড়াই এবং পীরেন স্নালের আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।

 

 

২০০৪ সালে বনবিভাগ টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনে জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের নামে “মধুপুর ইকোপার্ক” নামের এক অন্যায় প্রকল্প চাপিয়ে দিয়ে স্থানীয় বন ও আদিবাসী জনগণের ঐতিহাসিক সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিল। আদিবাসী জনগণের ইকোপার্ক-বিরোধী দীর্ঘ লড়াই এবং পীরেন স্নালের আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।

 

 

 উল্লিখিত ইকোপার্ক প্রকল্পসমূহের বিরুদ্ধেও স্থানীয় খাসি, মান্দি ও কোচ-বর্মণ আদিবাসীরা আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র তা আমলে নেয়নি। পাশপাশি বান্দরবানের চিম্বুকে ইকোপার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্থানীয় ম্রো, বম, চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা আদিবাসীরা আন্দোলন করলে তাও একসময় স্থগিত হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক বনভূমি ও আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে বারবার রাষ্ট্রের এসব ইকোপার্ক উন্নয়ন বাতিল ও অকার্যকর হচ্ছে জনগণ ও অরণ্য বিরোধী রাষ্ট্রীয় মনস্তত্ত্বের জন্য।

 

 

রাষ্ট্র বনভূমিকে বননির্ভর জনগণের যাপিত জীবনের অংশ হিসেবে না দেখে একে বহুজাতিক বাজারের পণ্য হিসেবে বিচার করছে। বননির্ভর জনগণের সহস্র বছরের অরণ্য-আখ্যানকে দূরে ঠেলে রাষ্ট্র এসব বিনোদন পার্কের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বনভূমি বিনাশ করে বহুজাতিক বাণিজ্যের মুক্তবাজার টেনে আনতে চাইছে। মূলত এসব বিনোদন পার্ক নিয়ে রাষ্ট্রের সাথে স্থানীয় আদিবাসী ও বননির্ভর জনগণের ভেতর এখানটাতেই বিবাদ ও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এমনকি ভাওয়াল গড়ের আলোচিত “বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক” সম্পর্কেও রাষ্ট্র কেবলমাত্র বাণিজ্যিক বিনোদন কেন্দ্রের প্রসঙ্গ তুলে ধরছে।

 

 

অর্থাৎ, শিল্পায়নের বাহাদুরি আর বহুজাতিক বাজার থেকে শালবনকে বাঁচানোর কোনো একবিন্দু চিন্তাও বনবিভাগের নেই। কিন্তু এটিই শালবনকে বাঁচানোর জন্য জরুরি প্রসঙ্গ। সাফারি পার্কের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র স্পষ্ট করেছে, থাইল্যান্ডের সাফারি ওয়ার্ল্ডের মতো করে এটি গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ তো সংস্কৃতি, প্রতিবেশ ও ঐতিহাসিকতায় থাইল্যান্ড নয়। এখানে অরণ্য জীবনের এক দীর্ঘ ঐতিহাসিকতা আছে, আছে অরণ্য জীবনের লোকায়ত বিজ্ঞান।

 

 

সাফারি পার্কের নামে বননির্ভর জনগণের প্রথাগত বনঅধিকার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাক আমরা তা কোনোভাবেই চাই না। বানিজ্যিক পার্কের মাধ্যমে শালবনে স্থানীয় জনগণের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত না হোক। বিদেশ থেকে একটার পর একটা বন্যপ্রাণী না এনে শালবনের প্রাকৃতিক প্রাণবৈচিত্র্যের বিকাশ ও সুরক্ষার ভেতর দিয়েই সত্যিকারের সাফারি পার্ক গড়ে তোলা সম্ভব। আর এসব বিষয় রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। 

[ নিবন্ধে ব্যবহৃত ছবিগুলোর আলোকচিত্রী লেখক স্বয়ং]

 

 

পাভেল পার্থ

লেখক, প্রাণবৈচিত্র সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষক

animistbangla@gmail.com

Your Comment