বুধবার ২০শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ Wednesday 4th June 2025

বুধবার ২০শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

Wednesday 4th June 2025

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

সেনা শাসিত জীবন: উচ্ছেদ অভিযানে বিলুপ্তির মুখে বম জনগোষ্ঠী

২০২৫-০৫-২৬

অহনা অথৈ

সেনা শাসিত জীবন: উচ্ছেদ অভিযানে বিলুপ্তির মুখে বম জনগোষ্ঠী

একটি বাঁশের বেড়ার ফাঁকে আটকে পড়ে আছে হলুদ, গেরুয়া ও লালের সংমিশ্রণে বর্ণময়, তবে প্রাণহীন একটি চঞ্চু, পাখির ঠোঁট। নাম তার ‘ধনেশ’ বা ‘রাজ ধনেশ’। পার্বত্য চট্টগ্রাম বা আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে এই পাখিটিকে ‘রঙরাঙ’ নামে ডাকা হয়। ‘রঙরাঙ’ বা ‘ধনেশ’ এর আবাস্থল, মুক্ত বনাঞ্চল। সাঙ্গু-মাতামুহুরীর গহীন বন ও যে পাহাড়ে তাদের কলোরব শোনা যেত, সেই পাহাড়টিরও তার নামেই নাম, ‘রঙরাঙ’। মূলত দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বনাঞ্চলে নানা প্রজাতির ধনেশের আবাস হলেও, শিকারীদের শিকার হয়ে আজকাল তার দেখা মেলা ভার। প্রদর্শনীর দেয়ালে ঝুলতে থাকা এই মৃত পাখির ঠোঁট শুধু তার অস্তিত্ব নয়, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমন-পীড়নের ফলে পাহাড়ি আদিবাসী একটি জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তির আভাস দিচ্ছে।

 

দৃক পিকচার লাইব্রেরি কর্তৃক রাজধানীর পান্থপথ, শুক্রাবাদ সংলগ্ন দৃকপাঠ ভবনে আয়োজিত বাংলাদেশ প্রেস ফটো কনটেস্ট (বিপিপিসি) ২০২৫ এর প্রদর্শনীর একটি দেয়ালের ভিন্নধর্মী এই ছবিগুলোতে আটকে যায় চোখ। এই দেয়ালের শিরোনাম লিভিং আন্ডার মিলিরটারাইজেশন বা সেনাশাসিত জীবন। বিপিপিসির অধীনে ২০২৪ সালে আদিবাসী জনগোষ্ঠী গ্র্যান্টজয়ী, আদিবাসী আলোকচিত্রী ডেনিম চাকমার ছবিগুলো মূলত, বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে নিপীড়িত বম জনগোষ্ঠীর কথা বলছে। গত ১৯ এপ্রিল থেকে ১৭ মে পর্যন্ত এই প্রদর্শনীটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল।

 

 

জুম্ম আদিবাসী আলোকচিত্রী ডেনিম চাকমার মতে, চলমান রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বম জনগোষ্ঠীকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টার প্রতীক হিসেবেই উঠে এসেছে মৃত রঙরাঙ পাখির দেহাবশেষ। অন্যান্য আলোকচিত্রে দেখা যায় মৃত সন্তানের ছবি হাতে অপেক্ষারত মা, যিনি বিশ্বাস করেন তার সন্তান এখনও নিখোঁজ। পাহাড়চূড়ায় সন্ধ্যালোকে একটি আদিবাসী পাড়া ঘেরাও করেছে সশস্ত্র বাহিনী। চিকিৎসা নিতে রুমা থেকে বান্দরবানে যাওয়ার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি অনুমতির আবেদন পত্র হাতে একজন জুম্ম বৃদ্ধ। পাহাড় কেটে, পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে তাদের জমি দখল করে, পাহাড় ঘেঁষে সেনাবাহিনীর উন্নয়ন সড়ক। এসকল আলোকচিত্রে স্পষ্টত ধরা দেয় পাহাড়ি আদিবাসীদের সংগ্রামী জীবন, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ণ তথা সেনাশাসিত জীবন।

 

উল্লেখ্য ২০২৪ সালের ২রা এপ্রিল কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) দুর্বৃত্ত কর্তৃক বান্দরবানের রুমা এবং থানচি উপজেলায় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ‘ যৌথ অভিযান’ শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় বান্দরবানের গোটা বম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে দেখা যায়। বম জনগোষ্ঠীর অভিযোগ নিরাপরাধ বম নারী, গর্ভবতী নারী, শিক্ষার্থী, চাকরীজীবী, বয়োজ্যেষ্ঠ এমনকি শিশুরাও ধরপাকড়, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার শিকার হন। সন্ত্রাসী বাহিনী কেএনএফ প্রধান নাথান বমকে একটি বিশেষ বাহিনীর প্রভাবশালী ও অসৎ সদস্যরা নিরাপত্তা দিচ্ছেন, উল্টোদিকে নাথান বমের দায়ে গোটা বম জাতিগোষ্ঠীকে শাস্তি পেতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের। ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে বান্দরবানে ও চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দী আছেন অনেক নিরাপরাধ বম, নারী ও শিশু।

 

সশস্ত্র বাহিনীর মিডিয়া উইং, আইএসপিআরের ভাষ্যমতে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। এই পরিস্থিতিতে আদিবাসী অধিকারকর্মী ও মানবাধিকারকর্মীদের প্রশ্ন, তাহলে সমগ্র বম জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী’র আখ্যা দেওয়া হচ্ছে? রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এই ভাষ্য ও অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি রেখেছে বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

 

আলোকচিত্রী ডেনিম চাকমা তার কাজের প্রসঙ্গে দৃকনিউজকে বলেন, যে নির্মম সত্য সব জায়গায় তুলে ধরার সুযোগ নেই, যে কথা শোনার কেউ নেই সে বিষয়ে কাজ করতে পেরেছি, সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এই সুযোগ তৈরি করে দেওয়ায় দৃককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান তিনি।

 

বাংলাদেশ প্রেস ফটো কনটেস্ট- এর অধীনে ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী গ্র্যান্ট ২০২৫’ অর্জন করেছেন সমতলের গারো আলোকচিত্রী জাজং নকরেক। দৃকের প্রত্যাশা টাঙ্গাইলের মধুপুরে গারো বা মান্দিদের জীবন-সংগ্রাম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান, প্রাণ-প্রকৃতি ও আদি বা সাংসারেক ধর্মসহ নানা বিষয়বস্তু তুলে আনার চেষ্টা করবেন জাজং। আগামী বছর প্রেস ফটো কনটেস্ট ২০২৬ এর প্রদর্শনীতে জাজং নকরেকের আলোকচিত্র প্রদর্শিত হবে।