বৃহঃস্পতিবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০ Thursday 28th March 2024

বৃহঃস্পতিবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

Thursday 28th March 2024

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

রোগের নাম দুর্নীতি, ভোগান্তির নাম লোডশেডিং

২০২২-১০-২১

আবু রায়হান খান

    

সর্বশেষ ব্ল্যাক আউটের পর দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার ধারে কাছেও নেই। থেমে থেমে  প্রতিদিন ৩ – ৬ ঘণ্টার লোডশেডিং পোহাতে হচ্ছে দেশবাসীকে।

 

কেন আবার লোডশেডিংয়ে ফিরতে হল?

 

  • বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই টাকা ব্যয়
  • বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশি কাঁচামাল ব্যবহার না করা
  • গ্যাসের কূপ খননেও অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত অর্থ খরচ
  • গ্যাস উত্তোলন না করে আমদানির দিকে ঝোঁক
  • নিশ্চিত ক্ষতি জেনেও আমদানি নীতি থেকে বের না হওয়া

 

  • বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই টাকা ব্যয়

 

সরকারি তথ্য বলছে, দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫৭৩০ মেগাওয়াট। কিন্তু সক্ষমতা থাকলেও তার অর্ধেকও উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে কেন্দ্রগুলো অলস বসে বসেই টাকা নিয়ে যাচ্ছে।

 

সরকারি সূত্র অনুযায়ী, গত ১১ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বিভিন্ন কোম্পানিকে ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার; আরও সহজভাবে বললে, পুরো টাকাটাই গিয়েছে জনগণের পকেট থেকেই।

 

 

  • বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশি কাঁচামাল ব্যবহার না করা

 

সাধারণত গ্যাস, তেল, কয়লাসহ আরও বেশ কিছু কাঁচামাল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এছাড়া স্রোত, বাতাস, সৌর প্রকল্পসহ প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপায়েও বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়।

ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ গ্যাস সমৃদ্ধ অঞ্চল হওয়াতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস হবে অন্যতম প্রধান কাঁচামাল। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, নিজেদের দেশের গ্যাস দিয়েই আগামী অন্তত ৩০ বছর চলতে পারবে বাংলাদেশ।

 

  • গ্যাসের কূপ খননেও অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত অর্থ খরচ

 

গ্যাস উত্তোলনে এতো অনীহার পরেও যে কয়টি কূপ খনন করা হচ্ছে সেখানেও অকারনেই অতিরিক্ত খরচ করছে সরকার। দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স যে কূপ ৮৫–৯০ কোটি টাকায় খনন করছে, সেখানে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে দেয়া হচ্ছে ১৮০ কোটি টাকারও বেশি। গ্যাস উত্তোলনে সাফল্যের পরিমাণ বিবেচনায় বিদেশি কোম্পানির চাইতে দেশি কোম্পানিই এগিয়ে থাকলেও তারপরেও কেন বেশি দামে বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দেয়া হচ্ছে সে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেউই।

 

“এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্যেও জন্য কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারী মামলা বা অন্য কোন প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না”

 

মিয়ানমারের সাথে সমুদ্র বিজয়ের পরেও গভীর সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের করতে পারছে না বাংলাদেশ। অথচ একই সমুদ্রসীমা থেকে প্রচুর গ্যাস সংগ্রহ করছে মিয়ানমার।

 

পেট্রোবাংলারও দুই বছর পর প্রতিষ্ঠা লাভ করা মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এখন অন্য দেশে গ্যাস অনুসন্ধান করছে, আর পেট্রোবাংলা নিজের দেশেই করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

  • উত্তোলন না করে আমদানির দিকে ঝোঁক

 

বিশ্ব বাজারে (স্পট মার্কেট) প্রতি মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজির মূল্য ছিল ৩ থেকে ৪ ডলার। কিন্তু দেশীয় গ্যাসের খরচ এক ডলারেরও কম।

 

আপদকালীন সংকট সমাধানের জন্য সরকার ২০১০ সালে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের প্রধান লক্ষ্যই ছিল আমদানিতে যে সব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আসে, সেগুলোর যেন বিচার না করা যায় তা নিশ্চিত করা।  এই আইনের ১০ নম্বর ধারাতে এই বিষয়টি স্পষ্ট করেই উল্লেখ করা আছে। এ  ধারায় বলা হয়, “এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্যেও জন্য কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারী মামলা বা অন্য কোন প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না”। ফলে আমদানি নীতিকে আইনী প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা করার সুযোগ হরণ করা হয়; যা নীতিটির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে।

 

বর্তমানে বিশ্ববাজারে গ্যাসের ও তেলের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সরকার কিছুদিন  অতি উচ্চমূল্যেই এলপিজি ও এলএনজি ক্রয় করলেও তা পরে আর তা সম্ভব হয়নি। যে কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন। যে কারণে এখন দেশে প্রচুর লোডশেডিং হচ্ছে এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ছে। উচ্চমূল্যে জ্বালানি ক্রয় করতে গিয়ে চাপ পড়ছে দেশের মজুতকৃত ডলারের ওপর। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, শুধুমাত্র বিদ্যুতের অভাবেই একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে অনেক শিল্প-কারখানা।

 

অথচ দেশীয় গ্যাস উত্তোলন করে সেই গ্যাসের ব্যবহার করলে যুদ্ধ কিংবা বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে দেশকে লোডশেডিংয়ের দিকে হাঁটতে হতো না। সেই সাথে এই ধরনের ব্ল্যাক আউটের মতো পরিস্থিতিও ঘটতো না।

 

  • নিশ্চিত ক্ষতি জেনেও এই নীতি থেকে বের না হওয়া

 

ক্ষতি হচ্ছে জেনেও এখনো আমদানি নির্ভর নীতির দিকেই হাঁটছে বাংলাদেশ। যার কারণে জনগণের ওপর চলমান অর্থনৈতিক চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সমগ্র বিশ্বে যাদের গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ এবং উপায় আছে তারা সবাই বিদেশ থেকে আমদানি না করে নিজের দেশের গ্যাস উত্তোলন করছে। কিন্তু বাংলাদেশ হাঁটছে উলটো পথে। আপদকালীন সমাধানের খোঁজে আমদানির যে নীতি সরকার প্রণয়ন করেছে সেই নীতিই এখন সবচেয়ে বড় আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংকট সমাধানের অনেক সহজ পথ ও উপায় থাকা সত্ত্বেও সমাধানের দিয়ে হেঁটে আরও সংকট তৈরি দিকে এগুচ্ছে সরকার, যার ফলাফল ভোগ করতে হবে এদেশের জনগণকেই।

Your Comment