শনিবার ৭ই বৈশাখ ১৪৩১ Saturday 20th April 2024

শনিবার ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

Saturday 20th April 2024

বহুস্বর মতামত

রেল নিয়ে আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিপদ

২০২২-০৭-২১

ফিরোজ আহমেদ

১.

রেল নিয়ে দুটো ঘটনা আমাদের চোখে পড়ল সম্প্রতি। একটা হলো রেলেরই দায়িত্বে থাকা সদ্য সাবেক একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার স্মৃতিচারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাপা হয়েছিল সেটা। “রেলের উন্নয়নে” তার প্রয়াস কীভাবে ব্যর্থ করে দেয়া হলো, সেটা ছিল পোস্টের একটা বিষয়, অন্য একটি বিষয় ছিল বিনা টিকিটে যাত্রীরা যে কত বড় অপরাধী, সেটা। রেলের উন্নয়নে একজন আমলার ব্যক্তিগত প্রয়াসের সাফল্যের সম্ভাবনা নিয়ে আমার সংশয় আছে, সেটাও পরবর্তীতে আলাপে আসবে।

 

 

গোয়ালাদের এত কঠোর শাস্তি দেয়ার পর সেই “আমলা রূপী বিচারক” আকবর আলি খান আশা করলেন, অপরাধীরা নিশ্চয়ই এবার সতর্ক হবে

 

ওই প্রতিক্রিয়াটির পাশাপাশি আরেকদিকে আমরা দেখেছি রেলের হাতে প্রতারণা ও বিড়ম্বনার শিকার হওয়া একজন যাত্রী মহিউদ্দীন রনির প্রতিবাদ। জীবনে যে ধরনের অপরাধগুলোর শিকার হলেও আমরা এড়িয়ে যাই ঝামেলা থেকে বাঁচবার জন্য, তেমন একটা ঘটনাতেই মহিউদ্দীন দাঁড়িয়েছেন এবং বলা চলে গোটা দেশের মানুষই তার সাথে সহমর্মিতা দেখিয়েছেন। মহিউদ্দীন রনিকে রেল কর্তৃপক্ষ শারীরিকভাবে নাজেহাল করেছে। কিন্তু তার অনড়তার কল্যাণেই নানান জায়গাতে রেলের এই দুর্নীতির শিকার যারা হন, তারা প্রতিবাদের চেষ্টা করেছেন। চট্টগ্রামে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের স্টেশনে প্রতিবাদ করতে দেয়া হয়নি, রাজধানীর উত্তরাতে শিক্ষার্থীরা টিকিট চোরাইপথে বিক্রির প্রতিবাদে রাতারাতি ট্রেন আটকে রেখেছেন তিন ঘণ্টা। এরপর আরও প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় অন্তত মহিউদ্দীন রনির প্রতিবাদের একটা সুরাহা হয়েছে, টিকিটে অনিয়মের অভিযোগে সহজ ডটকমের একটা জরিমানা হয়েছে।

 

 

কিন্তু রেল নিয়ে জনগণের সার্বিক দুর্দশার সুরাহা কি ঘটবে? এই সব নিয়েই খানিকটা ভাবা যাক। রেল নিয়ে না, রাষ্ট্রের সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো কেন সার্বিকভাবে ব্যর্থ হয়, সেটা নিয়েই কিছু পর্যালোচনা হাজির করতে চাই।

 

 

২.

যেকোনো সমস্যা সমাধানে “আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি” কেন বিপদজনক, সেই বিষয়ে অত্যন্ত শিক্ষামূলক, কিন্তু স্বল্পপ্রচলিত একটা “সত্যিকারের গল্প দিয়ে” লেখাটা শুরু করা যাক।

 

 

গল্পটা বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম একজন সচিব, আকবর আলি খানের। দক্ষতা-যোগ্যতা-উদ্যম ও সততার জন্য তিনি প্রায় সকলেরই শ্রদ্ধেয়। তার মতামতের সাথে মত-দ্বিমত যাই থাকুক না কেন, একজন অত্যন্ত সক্রিয় আমলাও যদি আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত একটা পদ্ধতির মাঝে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে কিছু না কিছু করার তাগিদেই কিছু একটা করে বসতে চান, সেটাও কীভাবে জনগণের জন্য বিপদজনক হতে পারে, এই গল্পটাতে সেই বিষয়েই আলাপ রয়েছে।

 

 

তো, আকবর আলি খানের আমলা জীবনের কাহিনী পাঠকদের ধৈর্য্যচ্যুতির কথা মাথায় রেখে বইটা থেকে গল্পটাকে অনুবাদে একটু সংক্ষিপ্ত এবং নিজের মতো করে হাজির করছি ।

 

 

আইয়ূব খানের আমলের শেষ দিক। আকবর আলি খান তখন সিলেটের হবিগঞ্জের এসডিও। ঘটনাটা ১৯৭০ সালের সামান্য কিছু আগে হবে। দায়িত্ব নিয়ে আকবর আলি খান দেখতে পেলেন সেখানে পানিতে দুধ মেশানোর শত শত মামলা ঝুলে আছে। কারণটা রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন আসায় দীর্ঘসূত্রিতা। দুধের রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন অবিলম্বে আনতে আকবর আলি খান তৎপর হলেন। তার সক্রিয়তার কল্যাণে দ্রুতই হাতেও পেলেন গোটা পঞ্চাশেক পরীক্ষার ফল।  প্রসঙ্গত বলে রাখি, তখনকার আমলে আমলাদের হাতে এখনকার চাইতে বিচার বিভাগের এখতিয়ার অনেক বেশি ছিল। এখনও তাদের হাতে কিছু ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা অটুট আছে, যেটার বিপুল অপব্যবহার হয়।

 

 

এবার তিনি একটা তারিখ ধার্য করলেন মামলা শুনানির। অনেক "অপরাধীকে" হাজিরও করা হলো। আসামীরা সব গ্রাম্য দরিদ্র লোকজন। গায়ে তাদের জরাজীর্ণ পোশাক। তাদের তাকতই ছিল না রাষ্ট্রের সাথে মামলা লড়বার। বরং নিজেরাই তারা ঝটপট রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদনকে সত্য বলে স্বীকারোক্তিও দিলো এবং দুধে তারা পানিই মিশিয়েছে, অন্য কিছু নয়, এমনটাও জানালো । নিঃশর্ত ক্ষমাও চাইলো তারা।

 

 

দয়ার্দ্র আকবর আলি খান আইন অনুযায়ী তাদেরকে ন্যূনতম শাস্তিটাই দিলেন। সেটা হলো ১৫০ টাকা জরিমানা। দুধ বিক্রেতারা জানালেন যে দুধ বেচে তারা ৬ মাসেও এত টাকা আয় করেন না। [প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার আগের বছর, ১৯৭০ সালে সরকারী হিসেবে সোনার ভরি ছিল ১৫৪ টাকা।] কিন্তু আইন বড় নির্মম, কোন ফাঁকি দেওয়ার উপায় সেখানে ছিল না। আইনটা বানানো হয়েছিল এই ঘটনার বছর দশেক আগে, আইয়ূব খানের শাসনের শুরুতে। আইয়ূবের শাসনের প্রধান দুই স্তম্ভ ছিল সেনাবাহিনী আর আমলাতন্ত্র। অপরাধী দুধওয়ালাদের ধারদেনা করে হলেও জরিমানাটা শোধ করতেই হলো।

 

 

আসল কাহিনীর শুরুটা এরপর। 

 

 

গোয়ালাদের এত কঠোর শাস্তি দেয়ার পর সেই “আমলা রূপী বিচারক” আকবর আলি খান আশা করলেন, অপরাধীরা নিশ্চয়ই এবার সতর্ক হবে, স্থানীয় বাজারে দুধে পানি মেশানোর হারটা কমে আসবে। তার এই বিচারের প্রভাব বাজারের ওপর কেমন হলো, সেটা জানতে সমাজবিজ্ঞানী রূপী আকবর আলি খান এবার স্থানীয় বিশ্বস্ত একজন বিদ্যালয় শিক্ষককে এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দিলেন।

 

 

সেই শিক্ষকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনখানা হাজির হবার পর আমলা-বিচারকের আক্কেলগুড়ুম! জানা গেল, কঠোর শাস্তি দেয়ার পরিণতিতে হবিগঞ্জের হাটে-বাজারে ভেজাল দুধের পরিমাণ বরং বেড়ে গেছে।

 

 

সেই শিক্ষকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনখানা হাজির হবার পর আমলা-বিচারকের আক্কেলগুড়ুম! জানা গেল, কঠোর শাস্তি দেয়ার পরিণতিতে হবিগঞ্জের হাটে-বাজারে ভেজাল দুধের পরিমাণ বরং বেড়ে গেছে।

 

 

কীভাবে?

 

 

খাদ্যে ভেজাল মেশানো হয় কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব ছিল স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের (এখন কাজটা করেন খাদ্য পরিদর্শকরা)। ভয়াবহ ওই জরিমানার ঘটনাটার পর এই পরিদর্শকরা গোয়ালাদের ভয় দেখাতে শুরু করল, পরিদর্শকদের খুশি করতে না পারলে দুধওয়ালাদের খবর আছে, নতুন “আধাপাগলা ম্যাজিস্ট্রেট” তো “তাদেরই হাতের মুঠোয়”, আর এবার মামলা খেলে সোজা কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হবে এদের!

 

 

দুধের মত একটা সাধারণ পণ্যের ব্যবসা করতে এর আগে ঘুষটা দিতে হতো না। কিন্তু এই পরিদর্শকদের সাথে ঝামেলায় যাবার মতো বুকের পাটা নিরীহ গোয়ালাদের থাকার কথা না, তারা বরং সরকারী এই চাকুরেদের চাহিদা মোতাবেক ঘুষটা দিয়েই দুধের ব্যবসা আর কারাগারের বেইজ্জতি, এই দুই মুসিবতের সমাধান করলো।

 

 

কিন্তু ঘুষের এই বাড়তি টাকাটা কোত্থেকে দিত তারা? রহস্যটা এখানেই। ঘুষের সেই পয়সাটা গোয়ালারা উসুল করতো দুধে আগের চাইতেও আরেকটু বেশি পানি মিশিয়ে।

 

 

কিন্তু ঘুষের এই বাড়তি টাকাটা কোত্থেকে দিত তারা? রহস্যটা এখানেই। ঘুষের সেই পয়সাটা গোয়ালারা উসুল করতো দুধে আগের চাইতেও আরেকটু বেশি পানি মিশিয়ে। আইয়ূবী সামরিক সরকারের আমলে আমলাতন্ত্রের ছিল একচ্ছত্র কর্তৃত্ব, অধিকাংশ জবাবদিহিতাহীন অগণতান্ত্রিক শাসনেই তাই হয়। বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীনতার কারণে এমনকি তাদের বিচ্ছিন্ন দুয়েকটা সদিচ্ছাও জনগণের দুর্দশা কীভাবে আরও বাড়িয়েই দেবে, এই গল্পটা সেই কাহিনীই বলে।

 

 

এভাবেই দুধে পানি মেশানোর বাস্তবতার কারণটা না জেনে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা সমস্যাটাকে আরও প্রবলতর করেছিল আকবর আলি খানের হবিগঞ্জে। তার হৃদয়টা একজন অনুসন্ধিৎসু ভাবুকের বলেই কারণটা তিনি উদঘাটন করেছেন, আমলা হিসেবে নিজের করা ভুলটা স্বীকার করেছেন এবং অন্যদের শিক্ষার জন্য লিখেও গিয়েছেন। এই কাজটি করার জন্য শুধু মেধা আর দাপ্তরিক দক্ষতা থাকলেই চলে না, প্রয়োজন হয় বিনয় ও নম্রতারও, ভুল স্বীকারের মানসিক শক্তির।

 

 

এভাবেই দুধে পানি মেশানোর বাস্তবতার কারণটা না জেনে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা সমস্যাটাকে আরও প্রবলতর করেছিল আকবর আলি খানের হবিগঞ্জে। তার হৃদয়টা একজন অনুসন্ধিৎসু ভাবুকের বলেই কারণটা তিনি উদঘাটন করেছেন, আমলা হিসেবে নিজের করা ভুলটা স্বীকার করেছেন এবং অন্যদের শিক্ষার জন্য লিখেও গিয়েছেন। এই কাজটি করার জন্য শুধু মেধা আর দাপ্তরিক দক্ষতা থাকলেই চলে না, প্রয়োজন হয় বিনয় ও নম্রতারও, ভুল স্বীকারের মানসিক শক্তির। সাম্প্রতিক সময়ের বহু ঘটনায় বোঝা যায়, আমলাতন্ত্রের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই এমনকি তাদের চাকরির প্রথম জীবনেই এই নম্রতাটুকু হারিয়ে ফেলেন।

 

 

আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই যথেষ্ট যেকোনো ব্যবস্থাকে দুর্নীতি আর অপচয়মূলক করার জন্য। কিন্তু বিপদ তো আরও হতে পারত। দুধে ভেজাল নিয়ে ঘুষ আদায়ের এই চক্রের উদাহরণটাতে আবারও ভাবুন, আকবর আলি খানের মতো সৎ আমলার বদলে যদি লাভজনক খাতটাতে অসৎ, নতজানু কিংবা দুর্বৃত্ত মানসিকতার কোনো আমলা থাকেন, গোয়ালা ও ক্রেতা রূপী জনগণের সার্বিক চিত্রটা কী দাঁড়াতে পারে?

 

 

গোটা বাংলাদেশের যে যে খাতের দুর্দশা নিয়ে আপনি ত্যক্ত-বিরক্ত, প্রতিদিন ভাবেন চিৎকার করে সেগুলোর প্রতিবাদ করা দরকার, সেই সবগুলো খাতের আসল বাস্তবতা এটাই।

 

 

৩.

আকবর আলি খান তার অনুসন্ধানজাত উপলব্ধির কথা অকপটে লিখেছেন। সমস্যার মূলটা আগে বুঝতে না চেয়ে উপর থেকে সমাধান চাপিয়ে দেয়াই ছিল এই বিপর্যয়ের কারণ। পূর্ব পাকিস্তানে তখন দুধের উৎপাদন এত কম হতো যে সেটাই দুধের একটা সত্যিকারের সঙ্কট তৈরি রেখেছিল।

 

 

আকবর আলি খান লিখেছেন, এখানে যারা ভেজালটি করতো, সেই গ্রামীণ কৃষকরা তখন পানি ছাড়া দুধে আর কিছু মেশাতো না, এবং বিশাল কোনো মুনাফাও তারা করতেন না। অধিকাংশ খদ্দেরও ছিলেন ক্ষুদ্র ক্রেতা, খাঁটি দুধের দাম দেয়ার মতো সামর্থ্য তাদের ছিল না, ফলে পানি না মিশিয়ে বিক্রি করাটা বিক্রেতার জন্য ছিল অসম্ভব। সরকারের দিক থেকে দুধের এই অপর্যাপ্ততার সঙ্কট মোকাবেলায় প্রধান কাজ হবার কথা ছিল দুধের চাহিদাটা মেটানো, দুধের উৎপাদনটা বৃদ্ধি করে।

 

 

গরিব বিক্রেতা, সামর্থ্যহীন ক্রেতা, দুধের সংকট, স্থানীয় সংস্কৃতি ইত্যাদির সাথে সম্পর্কহীন একজন গৎবাঁধা আমলা এই সম্পর্কসূত্রগুলো উপলব্ধি করতেই অক্ষম হবেন। তার সুবিধাজনক জীবন, নিরাপদ পরিবেশ, অনুকূল খাদ্যগ্রহণ, শাসনের স্পৃহা এবং সর্বোপরি "প্রজাকূলের" বাস্তবতার সাথে সংশ্রবহীনতা তাকে ট্রেনের টিকিট হোক আর দুধে ভেজাল হোক, সাধারণ মানুষ কোন বাস্তবতায় বাস করে, সেটা বুঝতে অক্ষম করে তোলে। এই বিচ্ছিন্নতার সাথে যদি যুক্ত হয় কাজ দেখাবার আকাঙ্ক্ষা পরিস্থিতিতে আরও নাজুক হতে পারে।

 

 

এভাবে তাই দুধের চাহিদা মেটাবার আগে “খাঁটি দুধ” বিক্রির আইন বাস্তবায়নে কড়াকড়ি এবং গোয়ালাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেট, আইন আর পরিদর্শকদের কাছে জিম্মি করার অর্থ হলো গরিব এবং কম বিপদজনক অপরাধীদের শক্তিশালী সংঘবদ্ধ ও দাপুটে অপরাধীদের হাতে ছেড়ে দেয়া, যারা এই দুর্বল ও উপায়হীন লোকগুলোকে আরো বেশি অপরাধে বাধ্য করবে। ফলে তাতে দুধ পাতলাতর হবে, আর শক্তিশালীতর হলো সংঘবদ্ধ অপরাধ। ঠিক এটাই ঘটেছিল আকবর আলি খানের হবিগঞ্জের কাহিনীতে।

 

 

৪.

এবার কল্পনা করুন এমন একটা পরিস্থিতি যেখানে সঙ্কট আরো ভয়ংকর। চাহিদাটা সেখানে যতখানি বাস্তব, তার চাইতে অনেক বেশি কৃত্রিম, মানে হলো এমন একদল লোক সমস্যাটা বানিয়ে রেখেছে, যাদের সেটা তৈরি করবার এবং তা থেকে ফায়দা তোলার সামর্থ্য আছে। আরও ধরে নিন, এই কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি যারা করেন, যারা তার সুফল ভোগ করেন তারাও দুর্বল গ্রাম্য গোয়ালা প্রজাতির নন, বরং তারা রাষ্ট্রের, সমাজের, বাণিজ্যের অনেক বেশি ক্ষমতাবান অংশ। আরো কল্পনা করুন, এই কৃত্রিম সঙ্কটে মরিয়া গণমানুষেরা বাধ্য হয়ে পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করছে, মারামারি করছে, আত্মঅবমানা করছে, অপরের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে… তেমন একটা বাস্তবতার মুখে আপনি আবারো কী আমলাতান্ত্রিক আকবর আলি খানের মতোই আইন অনুযায়ী কঠোর ভূমিকা রাখবেন, নাকি সমাজবিজ্ঞানী আকবর আলি খানের মত করে সঙ্কটটাকে বোঝার চেষ্টা করবেন?

 

 

আসুন, আমরা আমলার মতো করে সমস্যা সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গিটা আজও কীভাবে কাজ করে, সেটা বোঝার করি শুরুতে উল্লেখ করা একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ থেকে। এই সাবেক আমলা ভদ্রলোকের পেশাগত সুনাম, দক্ষতা ও নিষ্ঠা নিয়ে আমার পূর্ণ আস্থা আছে। কিন্তু তিনিও ঈদযাত্রার ব্যবস্থাপনায় রেলের সংকটকে কিভাবে দেখেছেন, সেটা বর্তমান আলোচনায়  দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করবার মতো। রেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাবেক এই আমলা সম্প্রতি যা লিখেছেন, সেখান থেকে কয়েকটি অংশ উদ্ধৃত করছি:

 

 

"কিভাবে বাড়ি যাব, বাড়ি যেতেই হবে, কাজেই কোচের ছাদে, ইঞ্জিনে আর টিকিটধারী যাত্রীর সিট দখল করে চলে যাব, এটা কখনোই হতে দেয়া যাবে না। কে কিভাবে বাড়ি যাবে বা আসবে, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত বা দায়িত্ব। অন্যের বৈধ অধিকার লংঘন করে নয়। ''

 

 

অর্থাৎ, এই আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যেহেতু “কে কিভাবে বাড়ি যাবে বা আসবে, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত বা দায়িত্ব”, ফলে নাগরিকদের ঈদে বাড়ি যাওয়া বিষয়ে রেল কর্তৃপক্ষ ভাববে না, তাদের ভাবার প্রধান জায়গাটা হবে যারা টিকিট কেটেছেন, (আসলে কাটতে সক্ষম হয়েছেন) শুধু তাদের অধিকারটুকু নিশ্চিত করা।

 

 

অন্যদিকে, রেলওয়ে জনগণের কোষাগার থেকে লক্ষ কোটি টাকার “উন্নয়ন কার্যক্রম” চালিয়েও এই যাত্রীদের নিরাপদ ভ্রমণের ন্যূনতম বন্দোবস্ত করতে সক্ষম না হয়, তার জবাবদিহিতা করার জন্য কিন্তু কাউকে আমরা আর দেখি না। রেলের এই হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের হিসাবের জবাবদিহিতা কে দেবে? কে চাইবে?- আমরা জানি না।

 

 

আবারও উদ্ধৃত করি তাকে:

 

 

“ বাড়ির উদ্দেশ্যে ঢাকা-গাজিপুর ছাড়া মানুষের কত পারসেন্ট বিনা টিকিটে রেলের ছাদে আর ইঞ্জিনে এবং কোচে দাঁড়িয়ে এলাকা ছাড়ে? ম্যাক্সিমাম ১% বা তারও কম। এই ছাদ আর ইঞ্জিন এবং ভিতরে অবৈধ যাত্রী হয়ে যাওয়া সামান্য অংশ কি মোট বাড়ি যাওয়া মানুষকে রিপ্রেজেন্ট করে?

 

 

কখোনই করে না। কাজেই এদের জন্য পুরো সিস্টেমকে ম্যাসাকার বা ধ্বংস করতে দেয়ার কোন অবকাশ বা সুযোগ নেই। এটা যেকোন উপায়ে রোধ করা প্রয়োজন। এদের আসল উদ্দেশ্য বিনা খরচে যাওয়া। “

 

 

১ শতাংশ! অথবা তারও কম যাত্রী ঈদে এইভাবে বাড়ি যায়!

 

 

কোন পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে আসলো এই তথ্য? কোনো জরিপ? কোনো অনুসন্ধান? নাকি একেবারেই নিজের অনুমান ও কল্পনা?

 

 

এই জনবিচ্ছিন্নতা ও কাল্পনিক বাস্তবতার মাত্রা দেখে আসলেই ভয় পেতে হয়। এই পোস্টেই মন্তব্যের ঘরে অবশ্য একাধিক ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী আলোকচিত্রসহ প্রমাণ দিয়ে জানিয়েছেন, রেলের দায়িত্ব পালন করা আমলা ভদ্রলোকের রেলযাত্রী বিষয়ে এই তথ্যগুলো সঠিক না। তাদের দেয়া কমলাপুর স্টেশন এবং আরও নানান জায়গায় ট্রেনের ছবিগুলোতে দেখা যাচ্ছে তিল ধারণের জায়গা নেই।

 

 

ঈদের ওই দিনগুলোতে টেলিভিশনের প্রতিবেদনগুলোতেও সরাসরিই দেখা গিয়েছে, যত লোক টিকিট পেয়েছেন, তার চাইতে অন্তত বহু গুন বেশি মানুষ টিকিট খুঁজছেন। না পেয়ে, এবং বাসে কিংবা অন্য পরিবহনে সুযোগ না পেয়ে বাধ্য হয়ে বিনা টিকিটের যাত্রী হয়েছেন।

 

 

বলে নেয়া দরকার যে, বিনা টিকিটের যাত্রীকে, কিংবা অন্যের আসন দখল করা যাত্রীকে বৈধতা দেয়ার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। কিন্তু প্রতি বছর ঈদের সময়ে একই দৃশ্য দেখে দেখে ক্লান্ত আমরা যখন সঙ্কটটাকে বুঝতে চাইবো, তখন নিতান্তই উপায়হীন হয়ে বিনা টিকিটের যাত্রী হওয়া এই অজস্র মানুষকে আদৌ কোনো দোষারোপ করতে পারি? বলতে পারি, তুমি এক শতাংশকেও প্রতিনিধিত্ব করো না, তুমি কেমনে বাড়ি যাবা, সেটা তুমি বুঝবা?

 

 

 নাকি আমরা জানি, এরাই অধিকাংশ জনগণ। ফলে ঈদে রেলস্টেশনে এই করুণ দৃশ্যগুলোর উত্তর আমাদের খুঁজতে হয় আসন সংখ্যা, ট্রেনের সংখ্যা, বগির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ, কিন্তু সেখান থেকেই ফায়দাও লোটা রেলওয়ের দুর্নীতি ও অদক্ষতার মাঝেই?

 

 

 

ট্রেনের কামরার ভেতরে কিংবা ছাদে তিল ধারনের জায়গা নেই, ছবিটি মাহবুব কবীর মিলনের পোস্ট থেকে নেয়া। সেখানে বেশ কয়েকজন পাঠক মন্তব্য আকারে এমন ছবি দিয়েছেন যেগুলো থেকে বোঝা যায় অধিকাংশ মানুষই ঈদে ট্রেনের টিকেট পাননি 

 

                                                                                                            

একইভাবে প্রশ্ন করা যায়, এই লক্ষ লক্ষ মানুষ, যারা বাধ্য হয়ে বিনা টিকিটের যাত্রী হচ্ছেন, তাদের “আসল উদ্দেশ্য বিনা খরচে যাওয়া” এই রকম একটা সিদ্ধান্তে আমরা কিসের ভিত্তিতে পৌঁছাচ্ছি?

আমরা কি কোন জনমত জরিপ করেছি? বিনা টিকিটের যাত্রীদের সাথে কথা বলেছি? তাদের কথা শুনেছি? অন্যের অধিকার হরণ করে এবং নিজের জীবনের ঝুঁকিও যে তারা নিচ্ছেন, কি তাদের প্রণোদনা, সেটা জানার কোনো চেষ্টা আমরা করেছি? তারা কি এমন জন্মগত অপরাধী যাদের জীবনের লক্ষ্য বিনা খরচে ঈদে বাড়ি যাওয়া? গণমানুষ সম্পর্কে এই হলো একজন মর্যাদাবান আমলার দৃষ্টিভঙ্গি?

 

 

৫.

যে পোশাক শ্রমিকটিকে টেলিভিশনে দেখতে পেলাম হাঁচড়ে পাঁচড়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে ঢুকছেন অচেনা সব মানুষের সাহায্য নিয়ে, তার দেহের অর্ধেকটা ট্রেনের বাইরে আর ভেতরে অর্ধেকটা, এমন অবস্থাতেও অনুভূতি জানতে চাওয়া সাংবাদিককে তিনি বললেন ”কী করতাম! ঈদে মা-বইনের কাছে যামু না!”;  কিংবা কামরার ভেতরে গাদাগাদি ভীড়ে গরমে অস্থির হয়ে জামা খুলে ফেলা আরেকজন যাত্রী যখন জানালার বাইরের সাংবাদিককে জানালেন “ভিতরে দোজখ ভাই ভিতরে দোজখ, কিন্তু মায়ে তো বাড়িতে বইসা থাকবো”, এবং দুইজনেই ওই অল্প সময়েই সাংবাদিককে এটাও জানালেন, টিকিট না পেয়ে তারা এইভাবে চড়েছেন, তখন আমরা বুঝতে পারি, বাংলাদেশকে যারা শাসন করেন, তারা বাংলাদেশের মানুষ নিয়ে ভিন্ন একটা কল্পজগতে থাকেন।

 

 

গণমানুষের অপরাধ প্রবণতা নিয়ে এই কল্পিত বাস্তবতার সাথে যুক্ত হয় ক্ষমতার নিখাদ যুক্তি: ঢাকা শহরে আত্মীয় স্বজন চৌদ্দগুষ্টি কেউ না থাকুক, তাই বলে এই লোকগুলো ঈদের সময় গ্রামে যেতে পাগল হবে? আইন ভাঙতে হবে?

 

 

গণমানুষ নিয়ে এই আশ্চর্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার সাথে নিষ্করুণ যুক্তিবোধ মিলে যে মনোবৃত্তিটা দানা বাধে, সেটারই ফলাফল বিনা টিকিটের এইসব “ভয়াবহ অপরাধীকে” দোষী সাব্যস্ত করে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে সব কিছুকে ঠিকঠাক করার ভাবনা। আমলারা প্রধান নীতিনির্ধারক হলে কোনোকালেই এর ব্যতিক্রম হবারও কথা না।

 

 

আর ওদিকে কিন্তু আইন ভাঙা অগণন মানুষেরা জানে, সারা বছরের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ওই কটা দিনই কেবল তাদের অবসর; ময়মুরুব্বী-পরিজনের মাঝে ওইটুকু সময়ই তারা মানুষের মর্যাদা পান। তাদের মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক যুক্তি ও বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে একদমই অক্ষম প্রথমোক্তরা।

 

 

বিনা টিকিটের যাত্রীরা কিন্তু বিনা পয়সায়ও যান না। আলোচ্য এই বিনা টিকিটের যাত্রীদের থেকে টিকিট বাবদ কোনো টাকা রাষ্ট্র না পেলেও এই যাত্রীরা টাকা ঠিকই খরচ করেন, সেই টাকার পরিমাণটা টিকিটের আসল দামের চাইতেও বেশিই হয়। ওই পোস্টেই দেখলাম মন্তব্যের ঘরে বেশ কয়েকজন এই রকম অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন।

 

 

বিনা টিকিটের যাত্রীরা কিন্তু বিনা পয়সায়ও যান না। আলোচ্য এই বিনা টিকিটের যাত্রীদের থেকে টিকিট বাবদ কোনো টাকা রাষ্ট্র না পেলেও এই যাত্রীরা টাকা ঠিকই খরচ করেন, সেই টাকার পরিমাণটা টিকিটের আসল দামের চাইতেও বেশিই হয়। ওই পোস্টেই দেখলাম মন্তব্যের ঘরে বেশ কয়েকজন এই রকম অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। এ কেমন দেশে আমরা থাকি, যেখানে আসল বাস্তবতা সম্পর্কে ভুক্তভোগীরা সকলে জানেন, শুধু জানেন না যাদের হাতে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, তারা?

 

 

ফলে, এই বিনা টিকিটের যাত্রীদের বড় অংশই আসলে:

ক. বাধ্য হয়ে বিনা টিকিটের যাত্রী। তারা চেয়েও টিকিট পাননি।

খ. তাদেরকে ঠিকই টাকা দিতে হয়, এই টাকাটা রেলের দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেরা নিয়ে থাকেন।

গ.তারা এতটাই নিরুপায় এবং বিকল্পহীন যে ট্রেনের ছাদে চড়তেও দ্বিধা করেন না, গাদাগাদি বগিতে জানালা দিয়ে ওঠারও চেষ্টা করেন, এবং পাদানিতে জায়গা পেলেও নিজেকে ধন্য মনে করেন।

ঘ. যাত্রীরাই শেষ পর্যন্ত নিয়োগ বাণিজ্যেরও শিকার। রেলের কর্মচারিদের এইভাবে বিপুল উপরি আয়ের সুযোগ আছে বলে বড় কর্তারা প্রতিটা নিয়োগে বিপুল অর্থ আয় করেন।

ঘ. উন্নয়ন বাণিজ্যেরও শিকার। যাত্রীদের দশা এমনটা আছে যে বাস্তবতায়, সেখানে রেল গত দশ বছরে অদৃষ্টপূর্ব পরিমাণে অর্থ ব্যয় করেছে উন্নয়নের নামে।

 

 

৬.

আমলাতন্ত্রের আরেকটা বাস্তবতা বিচ্ছিন্নতা।  ক্ষমতাবান নীতিনির্ধারক মানুষেরা সাধারণ জীবনের বহু বাস্তবতা থেকে একদমই বিচ্ছিন্ন। কেননা আপনি যদি একজন “ভিআইপি” হন, অর্থাৎ সোজা বাংলায় নানান বিভাগের কর্তা কিংবা কর্মকর্তা, অথবা আপনার সাথে ঘনিষ্ঠতা আছে কোনো যথাযথ আমলার, সেক্ষেত্রে আপনার জন্য ট্রেনের আসন, কামরা কিংবা অন্য যেকোনো বন্দোবস্ত কোনো ব্যাপার না। এই সহজলভ্যতার একটা সহজ ফলাফল হলো বাংলাদেশের অধিকাংশ আমলা আসলে জানেনই না এই সাধারণ মানুষগুলো কোন বাস্তবতায় বাস করেন? কী তাদের চাওয়া? কী তাদের বক্তব্য?

 

 

এই বিচ্ছিন্নতার ফলই হলো এমনকি আমলাতন্ত্রের মাঝেকার অধিকাংশ সৎ এবং দায়িত্বশীল কর্মকর্তাও সমস্যার গোড়ায় হাত দেয়ার বদলে (আসলে হাতটা দেয়ার সাধ্যও একজন ছোট বড় কিংবা মাঝারি আমলার নাই, সেটা ভিন্ন আলাপ) আইনের শাসন কার্যকর করতেই বেশি তৎপর থাকেন। ফলে নানান রকম ‘পরামর্শপত্র’ তারা চাপিয়ে দেন। যেমনটা আলোচ্য সেই লেখাতেও মিলবে:

 

 

“রেলে ৪ জন বা দুইজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রেলে সংযুক্ত থেকে কাজ করতেন ফিল্ডে। তাঁদের সাথে থাকবেন র‍্যাব, পুলিশ এবং এপিবিএন। ঈদের সময় এক্সক্লুসিভলি তিনটি স্টেশনে দায়িত্ব পালন করবেন। কমলাপুর, বিমানবন্দর এবং জয়দেবপুর স্টেশন। টিকিট ছাড়া কোন যাত্রী স্টেশনে প্রবেশ করতে পারবেন না। ট্রেনের ছাদে আর ইঞ্জিনে ওঠার তো প্রশ্নই ওঠে না।

 

 

সরকার চাইলে পারে না, এমন কিছু নেই। একজন টিকিটধারী যাত্রী টিকিট কেটে যদি ট্রেনে উঠতে না পারে বা সিট না পায়, তার সম্পূর্ণ দায় রেলের। এ দায় সম্পূর্ণ করার দায়িত্বও রেলের। “

 

 

সোজা বাংলায় বললে, রেলের দায় না আপনাদের সবাইকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া। রেল কেবল সেই সংখ্যাল্প মানুষের দায়িত্ব নেবে, যারা আদিম কায়দায় মারামারি করে কিংবা কালোবাজারিতে কিংবা ভিআইপি কোটায় কোনো একটা আসন যোগাড় করতে পেরেছেন। তাদের নিরাপত্তা দেবে ম্যাজিস্ট্রেট, র‍্যাব, পুলিশ, রেল পুলিশ ইত্যাদি।

 

 

অর্থাৎ বছরের পর বছর ধরে চলমান এই ঈদযাত্রায় ঢল ঠেকাতে বগির সংখ্যা বৃদ্ধি, ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি, ট্রেনের গতি বৃদ্ধির কোনো কার্যকর প্রস্তাব নয়, প্রধানতম সমাধান হিসেবে আসছে র‍্যাব, পুলিশ এবং এপিবিএন মোতায়ন। সমস্যার মূলটা চিহ্নিত করা এবং চাহিদা মেটানো নয়, যথাসাধ্য লাঠিশক্তির প্রদর্শন ও ব্যবহার করে বাড়ি যেতে মরিয়া লোকদের ঠেকানোই এখানে কার্যকর ভাবনা।

 

 

হবিগঞ্জের এডিসি আকবর আলি খানের কথা কি আবারো মনে পড়ছে পাঠকদের?

 

 

৭.

যতই দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয়দাতা হোক না কেন, সরকারের উচ্চতর জায়গা থাকা লোকজন কিন্তু ভালোই জানেন ঈদের ছুটি কাটানোতে বাধ দিতে চাইলে সব নিরাপত্তা ব্যবস্থাই শেষ পর্যন্ত মানুষের স্রোতে ভেসে যাবে। এমনকি সেই ঢলে আস্ত দুর্নীতির কারখানাটাও ধ্বসে যেতে পারে। তাই যতই বিনা টিকিটে যাত্রীদের দমনের প্রস্তাব আসুক, এত উদারহস্তে তারা র‍্যাব ইত্যাদির ব্যবহার করার চেষ্টাই করবে না। কিন্তু সাধারণভাবে জনতা সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই তাদের মাঝেও প্রচলিত।

 

 

এই প্রেক্ষিতেই পাঠকদের বলি, সমাধান চিহ্নিতকরণে এই মনোভঙ্গি কোনো একজন একক আমলার ত্রুটি নয়। সাধারণভাবে এটাই আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত। জনপ্রশাসন, সেনাবাহিনী কিংবা এই ধরনের সংস্থাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে এইভাবেই চলে। বাহিনী বা সংস্থা হিসেবে যেটি যত বেশি জনবিচ্ছিন্ন, এই আমলাতান্ত্রিকতা সেখানে তত বেশি। ফলে তাদের হাতে যখনই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পড়ে, ব্যক্তিক্রমী কিছু মানুষ বাদ দিলে লাঠ্যষৌধকেই তারা সবার আগে সহজ সমাধান হিসেবে বেছে নেন।

 

 

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ম্যাজিস্ট্রেটরা শত শত কোটি টাকার আম বিনষ্ট করেছিল, সমস্যার আগামাথা না ভেবেই

 

 

এ কারণেই ইতিহাসে বহু সময়ে ও বহু ঘটনায় এমনকি এইসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোই জনগণের মুখোমুখিও দাঁড়িয়ে যায়। এই সংঘাতের ক্ষয়ক্ষতি কমাবার জন্যই এমনকি বহুক্ষেত্রে পরদেশ দখলকারী সেনাবাহিনীগুলোও প্রতিষ্ঠানের বাইরের বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে থাকে পরিস্থিতিতিতে সহনীয় করতে।

 

 

সমস্যা নিয়ে ভাবাটা একটা কাজ হতে পারে, সেটা ভাবার জন্য দুনিয়া জুড়েই থাকেন বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞরা, এবং সাধারণ মানুষের পর্যালোচনা ও বিশেষজ্ঞদের মতামতই যে কোনো সমস্যা সমাধানে প্রধান দিকনির্দেশক হয়। সেখানে ভুল থাকবে না, এমন নিশ্চয়তা দেয়া অসম্ভব। বহুক্ষেত্রে এমন ভাড়া খাটা বিশেষজ্ঞও মিলবে, যারা দুর্নীতিপরায়ন আমলাতন্ত্রের অধীনস্ত থেকে তাদের সুবিধা অনুযায়ীই পরামর্শপত্র হাজিরও করেন। কিন্তু কোনো সংকটের গ্রহণযোগ্য সমাধান করতে চাইলে আমলাতান্ত্রিকতাকে এড়িয়ে জনগণ ও মুক্ত, স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ এবং সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। সিদ্ধান্ত জনগণের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং বিশেষজ্ঞদের জ্ঞানের বোঝাপড়া থেকেই আসতে হবে। বাস্তবায়নের বেলায় আমলাতন্ত্রের একটা ভূমিকা থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশে এটা সম্পূর্ণতই জবাবদিহিতাহীন আমলাতন্ত্রের একচেটিয়া এখতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

 

 

একটা পুরনো উদাহরণ দেই,আমাদের দেশের আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিতাহীন ভুল সিদ্ধান্ত ও বিচারহীনতার আদর্শ দৃষ্টান্ত হিসেবে যেটা জাজ্জল্জ্ল্যমান। মজার বিষয় হলো রেলওয়ের দায়িত্ব পালন করা এই আমলা ভদ্রলোক নিজেও সেই উদাহরণটির কথাই বলেছেন, কেননা সেই ঘটনাতে তিনিও সংশ্লিষ্ট ছিলেন : “আমি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে থাকাকালীন ৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এনেছিলাম সেখানে। প্রভূত উপকার হয়েছিল তাঁদের দ্বারা।

 

 

আদতে তিনি যখন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে ছিলেন, তখন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ম্যাজিস্ট্রেটরা শত শত কোটি টাকার আম বিনষ্ট করেছিল, সমস্যার আগামাথা না ভেবে। ফরমালিন “সনাক্ত” করার যন্ত্র কেনা হয়েছিল বিপুল অংক দিয়ে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা দেখিয়ে দিয়েছিলেন ওই যন্ত্রটা কোনো কাজ করে না। আরও হাস্যকর কিন্তু মর্মান্তিক সত্য হলো, ফলমূল শাক সবজিতে ফরমালিন কোনো কাজও করে না।

 

 

আদতে তিনি যখন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে ছিলেন, তখন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ম্যাজিস্ট্রেটরা শত শত কোটি টাকার আম বিনষ্ট করেছিল, সমস্যার আগামাথা না ভেবে। ফরমালিন “সনাক্ত” করার যন্ত্র কেনা হয়েছিল বিপুল অংক দিয়ে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা দেখিয়ে দিয়েছিলেন ওই যন্ত্রটা কোনো কাজ করে না। আরও হাস্যকর কিন্তু মর্মান্তিক সত্য হলো, ফলমূল শাক সবজিতে ফরমালিন কোনো কাজও করে না। পাঠকের সুবিধার্থে একটু স্মরণ করিয়ে দেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভ্যাল থেকে, এই তুঘলকি কাণ্ড উদঘাটন করা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলামকে উদ্ধৃত করে:

 

 

''ফরমালিন টেস্টের নামে যেসব কিট এখানে ব্যবহার করা হয়েছিল, ওই কিটগুলো ঠিক ছিল না। সেটা তখন বলায় বেনজীর আহমেদ (ডিএমপি'র তখনকার কমিশনার) আমাকে অ্যারেস্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু আদালতের নির্দেশে অ্যামেরিকায় পরীক্ষা করে এখন প্রমাণ হয়েছে ওই কিটগুলো ঠিক ছিল না।''

 

 

“ফরমালিন টেস্টের পদ্ধতি এবং কিট নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘ফরমালিন টেস্টের নামে যেসব কিট এখানে ব্যবহার করা হয়েছিল, ওই কিটগুলো ঠিক ছিল না। সেটা তখন বলায় বেনজীর আহমেদ (ডিএমপি'র তখনকার কমিশনার) আমাকে অ্যারেস্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু আদালতের নির্দেশে অ্যামেরিকায় পরীক্ষা করে এখন প্রমাণ হয়েছে ওই কিটগুলো ঠিক ছিল না।''

 

 

এই প্রেক্ষিতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তখনকার সদস্য মাহবুব কবীর মিলন ডয়চে ভ্যালকে যা বলেছিলেন, তা কৌতূহল জাগাবে। “তাহলে এত যে অভিযান, এত ফল-মূল ধ্বংস করা হলো, তা কি ভুল ছিল? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘হয়ত আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি৷ ফরমালিন পরীক্ষার কিট হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষা করে দেখা গেল আমাদের কিট ঠিক ছিল না৷ তবে সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে ওই অভিযান হয়েছে৷ তাই সেটা নিয়ে আমার কথা বলা ঠিক হবে না৷''

 

 

সরকারের প্রশাসনিক বা আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বিষয়ে কথা বলাটা তাদের জন্য বেঠিক হলেও জনগণের স্বার্থেই আমাদের বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হবেই। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কথিত এই উপকারটি আসলে বিশাল একটা অপকারই ছিল। আদতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নামের বিশাল এই আমলাতান্ত্রিক শ্বেতহস্তী এখনও জনগণের কি উপকারে আসছে, সেটা নিয়েও ভবিষ্যতে আমাদের অনেক আলাপ তুলতে হবে।

 

 

সরকারের প্রশাসনিক বা আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বিষয়ে কথা বলাটা তাদের জন্য বেঠিক হলেও জনগণের স্বার্থেই আমাদের বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হবেই। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কথিত এই উপকারটি আসলে বিশাল একটা অপকারই ছিল। আদতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নামের বিশাল এই আমলাতান্ত্রিক শ্বেতহস্তী এখনও জনগণের কি উপকারে আসছে, সেটা নিয়েও ভবিষ্যতে আমাদের অনেক আলাপ তুলতে হবে।

 

 

আমলাতান্ত্রিকতার সংকটের অন্য একটা দিক নিয়ে আলাপ করাটা জরুরি, সেটা না করলে এই কর্মনিষ্ঠ ও সৎ (অন্তত আমি যতদূর জানি) আমলা ভদ্রলোক সম্পর্কে বেইনসাফি হবে। তাকেই উদ্ধৃতি করা যাক:

 “ আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেও আমার দেয়া ১০ টি কল্যাণমূলক প্রস্তাব বা ই-নথির কোন কাজ করাতে পারিনি। হদিস নেই।“

 

 

ট্রেনের ছাদে চড়া এই বিনা টিকিটের যাত্রীরা নিশ্চয়ই প্রস্তাবগুলোকে চাপা দেয়নি। ট্রেন নিয়ে বা রাষ্ট্র নিয়ে যেকোনো আলাপ তো চাপা দেয়ার সামর্থ্য যাদের আছে, তাদের চিহ্নিত করাটাও জরুরি। কিন্তু হায়, আমরা দেখবো এই বেহদিস করে দিতে পারা বড় অপরাধীদের প্রতি কোনো প্রকাশ্য ক্ষোভ অবসরকালেও তার লেখায় নেই, কেবল আছে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়া এই গণমানুষের প্রতি বিষোদগার।

 

 

আমলাতন্ত্রে কোনো কিছু হারিয়ে যাবার সুযোগ নেই। বড় জোর বলা যেতে পারে কোনো কিছুকে চাপা দেয়া হয়েছে, কোনো একটা কিছুকে উপেক্ষা করা হয়েছে। কোন প্রসঙ্গ কেন কিভাবে চাপা পড়ে, সেটা আমরা হয়তো এতদিনে বুঝে গেছি সবাই।কথিত সেই “কল্যাণমূলক” প্রস্তাবগুলোর ভালোমন্দ নিয়ে বরং প্রকাশ্যে আলাপ তোলাটা জরুরি। ট্রেনের ছাদে চড়া এই বিনা টিকিটের যাত্রীরা নিশ্চয়ই প্রস্তাবগুলোকে চাপা দেয়নি। ট্রেন নিয়ে বা রাষ্ট্র নিয়ে যেকোনো আলাপ তো চাপা দেয়ার সামর্থ্য যাদের আছে, তাদের চিহ্নিত করাটাও জরুরি। কিন্তু হায়, আমরা দেখবো এই বেহদিস করে দিতে পারা বড় অপরাধীদের প্রতি কোনো প্রকাশ্য ক্ষোভ অবসরকালেও তার লেখায় নেই, কেবল আছে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়া এই গণমানুষের প্রতি বিষোদগার।

 

 

৮.

এই কারণেই হাতে শেকল জড়িয়ে একটা প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মহিউদ্দীন রনির প্রতিবাদটা জরুরি ছিল, যদি তা যথেষ্ট নাও হয়ে থাকে, দৃষ্টান্ত হিসেবে তা অনন্য। রেলের দেয়া প্রাত্যহিক লাঞ্ছনাটা না সয়ে নাগরিক হিসেবে তিনি তার দায়িত্বের পথটা বেছে নিয়েছেন। গণমানুষকে বঞ্চনা, প্রতারণা ও লুণ্ঠন করা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে তিনি তাই অনেক বড় কার্যকর একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।

 

 

মহিউদ্দিন রনির ভূমিকাটি যে অন্যদের প্রেরণা জুগিয়েছে, সেটাতে সন্দেহ নেই। আমরা দেখলামও, মহিউদ্দীনের লড়াই বিপুল অস্বস্তি ও চাপের জন্ম দিয়েছে রেলের ক্ষমতাবানদের মাঝে, সরকারের মাঝেও। বিশেষ করে উত্তরাতে শিক্ষার্থীরা দুর্নীতির প্রতিবাদে রেলপথ অবরোধ করার পর সেই চাপ আরও বেশি পরিষ্কার হয়। রনি একা বিচার পেলেও জনগণের পয়সা নদীতে ফেলা রেলকে পথে আনতে হলে, জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে অজস্র মানুষকে সামনের দিনে এই অবরোধে সামিল হতে হবে।

 

 

শুধু রেলই কেন, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত, বাংলাদেশের সড়ক খাত, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত, বলতে গেলে বাংলাদেশের সর্বত্র জবাবদিহিতাহীন এই আমলাতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি আর অদক্ষতার একটা এক একটা জগদ্দল পাথর যেন চেপে বসে আছে।

 

 

আমরা তো আশা করবো যাদের জন্য রেল, যাদের পয়সায় রেল, তারা রেল নিয়ে মুখ খুলুক। স্টেশনগুলোতে তারা ভীড় করুক, তাদের দাবি দাওয়া বক্তব্য আমরা পরিস্কার করে শুনতে চাই। যাক তারা সচিবালয়ে, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে, জবাবদিহিতা দাবি করতে আরও বেশি করে পথে নামুক। কেবল একটি ঘটনায় জরিমানা নয়, পুরো পদ্ধতির আমূল বদলের সূচনা হোক।

 

 

না হলে এমনকি এই বিশ্বসংকটের মুখেও জনগণকে কৃচ্ছতা সাধনের উপদেশ দিয়ে অসীম ক্ষমতাবান আমলাতন্ত্র নিজেদের ভোগবিলাস, সুবিধা, জবাবদিহিতাহীনতা আর দুর্নীতি পুরোটাই অটুট রাখবে।

 

 

শেষে আবারও বলতে চাই, রেলের ছাদে কোনো মানুষ উঠুক তা আমরা কেউ চাই না। কিন্তু পশুশক্তি ব্যবহার করে, লোহার বার কিংবা অন্য কিছু বসিয়ে নয়, যাত্রীদের চাহিদা মিটিয়েই তার সমাধান করা হোক।

 

 

 

ফিরোজ আহমেদ

লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক