শুক্রবার ২৬শে আশ্বিন ১৪৩১ Friday 11th October 2024

শুক্রবার ২৬শে আশ্বিন ১৪৩১

Friday 11th October 2024

বহুস্বর মতামত

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কর্তৃত্ববাদ: সেকুলারিজম ও উন্নয়নের বয়ান

২০২২-০৮-০২

সাইমুম পারভেজ

এই লেখাটি “সাম্প্রতিক বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী বয়ান: নির্মাণ ও প্রচারণা প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ ” প্রবন্ধের দ্বিতীয় পর্ব। এই প্রবন্ধে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারের টিকে থাকার পেছনে তিনটি মূল বয়ানের অবদান আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে বিশ্লেষণ করা হয়েছে কীভাবে সাম্প্রতিক আওয়ামী লীগ একটি ডানপন্থী দল হয়েও তার সেক্যুলার পরিচিতি বজায় রেখেছে। একইসাথে সেকুলারিজম ও ধর্মীয় বয়ান ব্যবহার করে শাসন ক্ষমতার বৈধতার পক্ষে নিজেদের বয়ান তৈরি করেছে। এই পর্বে উন্নয়ন বয়ানের গুরুত্বও তুলে ধরা হবে। এই প্রবন্ধ দাবি করে যে, অবকাঠামোগত দৃশ্যমান উন্নয়নের বয়ান দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ও উন্নয়নকে একসাথে করে উন্নয়নকে একটি অলঙ্ঘনীয় ও প্রশ্নাতীত জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যেখানে দুর্নীতির অনুসন্ধানের চাইতে অবকাঠামোর উদযাপন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম পর্বে আলোচিত মুক্তিযুদ্ধের মহান বয়ান এবং এই পর্বে উল্লেখিত সেকুলারিজম ও উন্নয়নের বয়ান- এই তিনটি বয়ান একসাথে ক্ষমতাসীন কর্তৃত্ববাদী সরকারকে "বিকল্পহীন" হিসেবে উপস্থাপিত করে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিকে জায়েয করার চেষ্টা করে।

 

 

আমরা এমন  সময়ে উন্নয়নের উদযাপন করছি যখন আগুনে পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের পরেও বিদ্যুৎবিহীন জীবন কাটাতে হচ্ছে।

 

 

বর্তমান ক্ষমতাসীন দল নিজেদের একটি মধ্যমপন্থী বামঘেঁষা দল হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। এই দলের বয়ান অনুযয়ী তারা দেশে সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করে আসছে। এই বয়ান অনুযায়ী আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করে না এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধী। এই অংশের আলোচনায় আমি এই বয়ানের অসারতা তুলে ধরব। [১]  

 

 

সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতি বিবেচনা করলে আওয়ামী লীগকে একটি ডানপন্থী দল বলা যায়। ডানপন্থী বা উগ্র-ডানপন্থী কেন বলছি সেটি বোঝার জন্য আমাদের কোন চিন্তা বা মতকে বামপন্থী ও ডানপন্থী বলা হয় এবং কেন বলা হয় তার ইতিহাসটি জেনে নেয়া উচিত।

 

 

১৭৮৯ সালে শুরু হয় ফরাসি বিপ্লব, বিদ্রোহী জনগণ বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটায়। এই উত্তাল সময়ে ফ্রান্সের জাতীয় সংসদ এর অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল নতুন বিপ্লবী সরকারের সংবিধান তৈরি করা। এই সংসদে বিতর্কের একটি অন্যতম বিষয় ছিল কতটুকু ক্ষমতা রাজার কাছে থাকবে সেটা সংবিধানে নির্ধারণ করা। রাজা কি কোনো সিদ্ধান্তে ভেটো দিতে পারবেন? আলোচনায় যারা রক্ষণশীল বা রাজার হাতে ক্ষমতা রাখার পক্ষে ছিলেন তারা সবাই একজোট হয়ে বসেন সংসদের ডান পাশে আর যারা এর বিপক্ষে ছিলেন তারা বসেন বাম পাশে। সংসদের পরবর্তি সব আলোচনাতেই আইনপ্রণেতারা এভাবেই বসেন। শুধু ফ্রান্স নয়, পুরো পৃথিবীর চোখ ছিল তখন এই বিপ্লবের উপর। ফ্রেঞ্চ সংবাদপত্রগুলোর দেখাদেখি এই পরষ্পরবিরোধী দুই দলকে ডানপন্থী এবং বামপন্থী বলা শুরু করে প্রায় সবদেশের সংবাদপত্রগুলো। এভাবেই ধীরে ধীরে রাজনৈতিক পরিচয়ের বহুল প্রচলিত এই দুটি ধারার নামকরণ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে।

 

 

ফরাসী বিপ্লবের পর গত দুই শতকে রাজনীতিতে নানা পরিবর্তন আসলেও রাজনৈতিক পরিচয় নির্ধারণের এই সহজ সরল মাপকাঠিটি টিকে আছে। বর্তমান পৃথিবীতে বাম মতবাদ মানে প্রগতিশীল এবং এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট (প্রথাগত চিন্তা বিরোধী) এবং ডান মতবাদ হচ্ছে রক্ষণশীল এবং প্রো-এস্টাবলিশমেন্ট (প্রথা-রক্ষাকারী)। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত নিজেকে উগ্র ডানপন্থী বা বামপন্থী হিসেবে পরিচিতি দেয় না, বরং একে অপরকে অভিযুক্ত করতেই এ ধরনের তকমা ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে, অভিবাসী এবং অভিবাসন বিরোধী ঘৃণা ছড়ানো রাজনীতিকে অতি ডানপন্থার অন্যতম লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইউরোপে ও যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ফার-রাইট বা অতি ডানপন্থী গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ধরনের রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের উত্থানকে এখন বিশ্বরাজনীতির নতুন ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন গবেষকরা।

 

 

এই অতি ডানপন্থীরা মূলত তীব্র জাতীয়তাবাদী। এরা মনে করে, তাদের জাতিই শ্রেষ্ঠ; অভিবাসীরা তাদের গায়ের রং এবং আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান সংস্কৃতিকে কলুষিত করছে; তাদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। মূলত এসব বয়ানকে সামনে রেখেই এই অতি ডানপন্থীরা সংগঠিত হয়। অতি ডানপন্থীরা একই সঙ্গে ইহুদি এবং মুসলিম বিরোধী। তবে এখন যেহেতু ইউরোপ-আমেরিকায় অভিবাসীদের একটি বড় অংশই মুসলিম, ফলে এই ডানপন্থীদের ঘৃণা ও আক্রমণের লক্ষ্য এখন ইসলাম ধর্ম পালনকারীরা।

 

 

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিতার একটা বড় সংকট হচ্ছে অতি ডানপন্থা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে বিরোধিতা করা তো দূরের কথা, উল্টো অতি রক্ষণশীলতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা। বাংলাদেশে অতি ডানপন্থী দল ও মতবাদ হিসেবে বুদ্ধিজীবিরা শুধু রক্ষণশীল ধর্ম-কেন্দ্রিকতার কথাই বলেন। অতি জাতীয়তাবাদী বয়ানকে যখন পুরো পৃথিবী জুড়েই অতি-ডানপন্থা হিসেবে বিবেচিত করা হয়, তখন বাংলাদেশে এ ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মতবাদকে ডানপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে অতি  জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উদযাপন করতে দেখা যায়। 

 

 

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিতার একটা বড় সংকট হচ্ছে অতি ডানপন্থা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে বিরোধিতা করা তো দূরের কথা, উল্টো অতি রক্ষণশীলতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা। বাংলাদেশে অতি ডানপন্থী দল ও মতবাদ হিসেবে বুদ্ধিজীবিরা শুধু রক্ষণশীল ধর্ম-কেন্দ্রিকতার কথাই বলেন। অতি জাতীয়তাবাদী বয়ানকে যখন পুরো পৃথিবী জুড়েই অতি-ডানপন্থা হিসেবে বিবেচিত করা হয়, তখন বাংলাদেশে এ ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মতবাদকে ডানপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে অতি  জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উদযাপন করতে দেখা যায়। 

 

 

এখানে উদাহরণ হিসেবে শাহবাগ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভিত্তিক অতি-জাতীয়তাবাদী চেতনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি গণমানুষের যুদ্ধ, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-রাজনৈতিক মতবাদের মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন, যুদ্ধ করেছিলেন বৈষম্য, অত্যাচার ও গণহত্যার বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহায়তাকারী বাংলাদেশীদের বিচার একটি যৌক্তিক দাবি।

 

 

কিন্তু গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধের যে নানা দিক, নানা বর্ণ, তা উগ্র-জাতীয়তাবাদীদের কাছে এসে শুধুই সাদা-কালো বাইনারি ন্যারেটিভ। এই সাদা-কালো বিভাজনের কারণে মুক্তিযুদ্ধকে "স্বর্গীয় ঘটনা", মুক্তিযোদ্ধাদের "স্বর্গীয় দূত", এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতাকে প্রশ্নাতীত ও সমালোচনার উর্ধ্বে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যা আমি আগেই আলোচনা করেছি। শুধু সমালোচনা নয়, উগ্র-জাতীয়তাবাদীদের মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে যে সুনির্দিষ্ট বয়ান, সেই বয়ানের বিন্দুমাত্র বাইরে যায় এমন কোনো মতবাদকে তীব্রভাবে আক্রমন করা হয়। তাই এই ধরণের উগ্র জাতীয়তাবাদী মতবাদ সুনির্দিষ্টভাবে আদালতের রায় কী হবে, ইতিহাসের বই কীভাবে লিখতে হবে, আর ইতিহাসের কোন অংশ বিশ্বাস আর কোন অংশ অবিশ্বাস করতে হবে তা ঠিক করে দেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই উগ্র-ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোকে প্রতিরোধ করার অস্ত্র হিসেবে এই অতি জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে বেছে নেন, যা একই সঙ্গে অকার্যকর ও সমাজের জন্য হানিকর। 

 

 

এ কথার মানে এটা নয় যে, হেফাজতে ইসলাম বা জামায়াতে ইসলামের মতো রক্ষণশীল ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সমর্থন জোগানো উচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থানের জন্য শুধু জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নয়, দলেরও বিচার হওয়া উচিত। বর্তমান সময়ে হেফাজত ইসলামের যে উত্থান, সংগঠিত গোষ্ঠী হিসেবে তাদের রক্ষণশীল দাবি-দাওয়ার পক্ষে যে শক্তি প্রদর্শন, তা আসলে সামাজিক প্রবণতা ডানপন্থার দিকেই ঝুঁকে যাবার লক্ষণ।

 

 

ধর্মভিত্তিক দল বা গোষ্ঠী মতবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে আবার অতি ডানপন্থী জাতীয়তাবাদকে বৈধতা দেয়া হলে তা দিন শেষে ধর্মভিত্তিক রক্ষণশীলতার হাতকেই শক্তিশালী করে। বিরোধিতার রাজনীতিকে সহজ-সরল মনে হলেও আদতে তা জটিল সংকট তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের জনযুদ্ধের বৈশিষ্ট্যকে উপেক্ষা করে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা”  বলে একটি নির্দিষ্ট মহান বয়ান তৈরি করা এবং এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে একটি অলঙ্ঘনীয় ধর্মের মতো মতবাদে পরিণত করা, একটি নির্দিষ্ট দলকে মুক্তিযুদ্ধের হেফাজতকারী হিসেবে চিহ্নিত করে সমালোচনাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত করা, সরকার ও রাষ্ট্রকে এক করে ফেলে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো নাগরিক অধিকারকে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করাটা স্পষ্টভাবেই অতি-জাতীয়তাবাদী ডানপন্থার বৈশিষ্ট্য।

 

 

কিন্তু এসব ধর্মভিত্তিক দল বা গোষ্ঠী মতবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে আবার অতি ডানপন্থী জাতীয়তাবাদকে বৈধতা দেয়া হলে তা দিন শেষে ধর্মভিত্তিক রক্ষণশীলতার হাতকেই শক্তিশালী করে। বিরোধিতার রাজনীতিকে সহজ-সরল মনে হলেও আদতে তা জটিল সংকট তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের জনযুদ্ধের বৈশিষ্ট্যকে উপেক্ষা করে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা”  বলে একটি নির্দিষ্ট মহান বয়ান তৈরি করা এবং এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে একটি অলঙ্ঘনীয় ধর্মের মতো মতবাদে পরিণত করা, একটি নির্দিষ্ট দলকে মুক্তিযুদ্ধের হেফাজতকারী হিসেবে চিহ্নিত করে সমালোচনাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত করা, সরকার ও রাষ্ট্রকে এক করে ফেলে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো নাগরিক অধিকারকে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করাটা স্পষ্টভাবেই অতি-জাতীয়তাবাদী ডানপন্থার বৈশিষ্ট্য।

 

 

দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর একটি প্রিয় কাজ হচ্ছে নিজেদের পছন্দমাফিক  জাতীয়তাবাদী ইতিহাস বিনির্মাণ করা এবং নিজেদের স্বার্থরক্ষাকারী এই একক বয়ান ইতিহাসকে আইনের মাধ্যমে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করা। এই প্রক্রিয়ায় জনভিত্তিহীন সরকারগুলো ধর্ম বা জাতীয়তাবাদের মতো ডানপন্থার উপর ভর করে নিজেদের দীর্ঘমেয়াদ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, সরকারের জবাবদিহিতা না থাকা ও শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাবে হেফাজত ইসলামের মতো ধর্মভিত্তিক অতি ডান গোষ্ঠী আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পেরেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হেফাজতকে ব্যবহার করা হয়েছে, যা আসলে দিনশেষে এই অতি-ডান গোষ্ঠীটিকে শক্তিশালী করেছে। তাই হেফাজতের প্রতিবাদ করার ন্যায্য অধিকার হরণ ও আন্দোলনে মানুষের মৃত্যু বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের কষ্ট দেয় না। অন্যদিকে হেফাজতের নেতৃবৃন্দও বস্তুগত প্রয়োজনে জনভিত্তিহীন এই সরকারকে মেনে নিতে দ্বিধা করে না।

 

 

ফলে বাংলাদেশে অতি ডানপন্থী এই দুই শিবিরের উত্থান সমাজে অস্থিরতা, মেরুকরণ এবং রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়াচ্ছে। তীব্র জাতীয়তাবাদ ও গোঁড়া ধর্মভিত্তিক মতবাদের মধ্যে আসলে তেমন পার্থক্য নেই। তারা একে অপরের শত্রুতাকে নিজেদের শক্তিশালী করার পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে।

 

 

বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী সরকার সহজেই ধর্ম নামক জুজুর ভয় তৈরি করে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিকে বৈধ করার চেষ্টা করছে। কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব একই সাথে "কওমি জননী" ও "সেক্যুলার" হয়ে উঠেছে। জার্মান গবেষক ইয়াসমিন লর্চ তার গবেষণায় যথার্থ দেখিয়েছেন যে, বাংলাদেশে সেক্যুলার নামধারী রাজনৈতিক দল নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থে সমাজে ইসলামাইজেশন বা ধর্মের প্রভাবকে বাড়িয়েছে।

 

 

তাই বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী সরকার সহজেই ধর্ম নামক জুজুর ভয় তৈরি করে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিকে বৈধ করার চেষ্টা করছে। কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব একই সাথে "কওমি জননী" ও "সেক্যুলার" হয়ে উঠেছে। জার্মান গবেষক ইয়াসমিন লর্চ তার গবেষণায় যথার্থ দেখিয়েছেন যে, বাংলাদেশে সেক্যুলার নামধারী রাজনৈতিক দল নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থে সমাজে ইসলামাইজেশন বা ধর্মের প্রভাবকে বাড়িয়েছে।[ ২]

 

 

এ অবস্থায় দেশে এই অতি ডানপন্থী গোষ্ঠী দুটিকে মোকাবেলা করার জন্য, গণতান্ত্রিক, উদার ও মধ্যপন্থী রাজনৈতিক চর্চা ফিরিয়ে আনার জন্য, যে কোনো একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্মতা নয়, বরং দুটি গোষ্ঠীকেই সঠিকভাবে চিহ্ণিত করা দরকার।

 

 

একদিকে নিজেকে বামঘেঁষা সেকুলার দল ও অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীগুলির সাথে কৌশলগত বোঝাপড়ার মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদীতা টিকিয়ে রাখা একটি চমকপ্রদ বিষয়। এর সাথে সাথে প্রধান বিরোধী দলকে বারবার জঙ্গীবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট হিসেবে অভিযুক্ত করা এবং বিএনপি-জামায়াত কে একই ব্রাকেট-বন্দী করে ফেলতে পারা নি:সন্দেহে এই বয়ানের অন্যতম 'সফলতা'।

 

 

[পড়ুন "সাম্প্রতিক বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী বয়ান: নির্মাণ ও প্রচারণা প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ" প্রবন্ধের প্রথম পর্ব]

 

উন্নয়নের বয়ান

যুগে যুগে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী সরকারগুলোর টিকে থাকার একটি অন্যতম বয়ান হচ্ছে উন্নয়ন। দৃষ্টিগোচর উন্নয়ন সাধন, বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়ন, যেমন রাস্তা, বড় সেতু, ভবন এবং বিশাল আকারের মূর্তি ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে তারা জনমানসে জায়গা করে  নিতে চান। বর্তমান বিশ্বে "চাইনিজ মডেল" এর দোহাই দিয়ে উন্নয়নের বিনিময়ে গণতন্ত্রহীনতা বা কম গণতন্ত্রে জনগণের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিজেদের বাক-স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার হওয়া কম প্রয়োজন- এ রকম তত্ত্ব নিয়ে অনেকে হাজির হন। সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ কর্তৃত্ববাদী সরকারের সমর্থক বুদ্ধিজীবিদের অনেকেই উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নির্বাচনী জালিয়াতি ও গণতন্ত্রহীনতার কলংককে ঢেকে রাখতে চান। উন্নয়নের বয়ানকে সমানে আনতে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি উন্নত অর্থনীতির দেশের সাথে তুলনা করেন এই সরকারের মন্ত্রীরা। 

 

 

মূলত বর্তমান সরকার তাদের টিকে থাকাকে বৈধ করতে উন্নয়নের বয়ানকে ব্যবহার করছেন। [৩]

 

 

এই উন্নয়নের পথযাত্রায় দেশের মানুষ নয়, বরং মূলত ধনিক শ্রেণীই লাভবান হচ্ছে। তাই ক্ষমতার আশেপাশে থাকা যেকোন গোষ্ঠীর বিনিয়োগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকেও 'উন্নয়ন-বিরোধী' হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে বলে আমরা শুনে আসছি। উন্নয়নের এই স্তুতি দেশের গণ্ডি ছড়িয়ে দেশের বাইরেও শোনা যায়। বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফও তাদের উন্নয়নের সফলতা দেখাতে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করে। মানবউন্নয়ন সূচকের নানা ধারায় বাংলাদেশ কিভাবে দ্রুতগতিতে উন্নতি করছে তা নিয়ে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন।

 

 

 সুশাসন, শক্তিশালি রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়াও বাংলাদেশ কিভাবে উন্নয়ন করছে তা অনেকের কাছে একটি ধাঁধা। তবে বাংলাদেশের এই দ্রুত উন্নতির প্রতিফলন কি সমাজের সব স্তরে রয়েছে নাকি অল্প কিছু মানুষই ধন-সম্পদের পাহাড় গড়ছেন তা একটি জরুরি প্রশ্ন। জিডিপি বা মাথাপিছু আয়ভিত্তিক উন্নয়নের পরিমাপে অতিধনীর সম্পদের বায়বীয় ভাগ পাচ্ছে অতিদরিদ্ররা। 

 

 

 সুশাসন, শক্তিশালি রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়াও বাংলাদেশ কিভাবে উন্নয়ন করছে তা অনেকের কাছে একটি ধাঁধা। তবে বাংলাদেশের এই দ্রুত উন্নতির প্রতিফলন কি সমাজের সব স্তরে রয়েছে নাকি অল্প কিছু মানুষই ধন-সম্পদের পাহাড় গড়ছেন তা একটি জরুরি প্রশ্ন। জিডিপি বা মাথাপিছু আয়ভিত্তিক উন্নয়নের পরিমাপে অতিধনীর সম্পদের বায়বীয় ভাগ পাচ্ছে অতিদরিদ্ররা। 

 

 

নিউইয়র্কভিত্তিক ওয়েল-এক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের প্রথম ১০টি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। যে কয়েকটি দেশে সবচেয়ে বেশি নতুন ধনী, নতুন মিলিওনিয়ার তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষপর্যায়ের একটি দেশ। [৪]

 

 

আর এই কথিত উন্নয়নের মান নিয়েও প্রশ্ন তোলা দরকার।  ২০২০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর গবেষণায় দেখা যায় করোনা মহামারিতে দারিদ্রের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। আমরা এমন  সময়ে উন্নয়নের উদযাপন করছি যখন আগুনে পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের পরেও বিদ্যুৎবিহীন জীবন কাটাতে হচ্ছে। আর এর মধ্যেই চলছে দুর্নীতি আর লুটের মচ্ছব। মৃত্যু যখন কড়া নাড়ছে অনিশ্চিত জীবনের দরজায়, তখনও লোভ আমাদের পিছু ছাড়ে না। এমনকি করোনা মহামারি আসার আগেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাথে সাথে ধনী-গরিব বৈষম্যও বেড়েছে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৭-১৮: প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ অনুযায়ী বাংলাদেশে ধনীরা আরও ধনী আর গরিবরা আরো গরিব হচ্ছেন। সবচেয়ে দরিদ্র পাঁচ শতাংশের খানা প্রতি আয় (হাউজহোল্ড ইনকাম) ২০০৫ সালে ছিল ১১০৯ টাকা। ২০১৬ সালে তা কমে ৭৩৩ টাকা হয়। আর ধনী পাঁচ শতাংশের ২০০৫ সালে খানা প্রতি আয় ছিল ৩৮ হাজার ৭৯৫ টাকা। এই আয় ২০১৬ সালে দ্বিগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকায়। [ ৫ ]

 

 

 তাই যে ব্যবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ বসবাস করছে, তা যেন একচক্ষু বিশিষ্ট। এই একচোখে কেবল ধনিক শ্রেণীর সুবিধা দেখে আর উপরে উঠার সিঁড়ি তৈরি করে দেয়। খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাপনে নাভিশ্বাস উঠে, আর প্রতিবাদ করলেই ধেয়ে আসে জুলুম।

 

 

উন্নয়নের এই বয়ান এতই শক্তিশালী যে, নতুন অবকাঠামোকে অনেক সময় তীর্থস্থানের মত মর্যাদা দেয়া হচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে না দেখে অবকাঠামোর সাথে জাতীয়তাবাদী আবেগকে যুক্ত করে উন্নয়নের বয়ানকে পূর্ণতা দেওয়া হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেলের মত নতুন নতুন মেগাপ্রোজেক্ট এর উদ্বোধন এই বয়ানকে আরো শক্তিশালী রূপ দিতে পারে।

 

 

বয়ান তৈরির সাথে বয়ানকে সঠিকভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রবন্ধের পরবর্তি অংশে, তৃতীয় ও শেষ পর্বে, আমি আলোচনা করব কিভাবে বয়ান নির্মাণের সাথেসাথে এই কর্তৃত্ববাদী সরকার বয়ান প্রচারণা করে। 

 

 

সাইমুম পারভেজ

বেলজিয়ামের ফ্রাই ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলস-এর রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক। 

ইমেইল অ্যাড্রেস: saimumparvez@gmail.com

 

 

তথ্যসূত্র :

                                          

১. এই প্রবন্ধের একটি অংশ এর আগে "বাংলাদেশে ডানপন্থার উত্থান ও বুদ্ধিজীবিতার সংকট" শিরোনামে প্রকাশিত হয়। দেখুন https://netra.news/2021/2021-05-27-16-02/

২. Lorch, J. (2019). Islamization by Secular Ruling Parties: The Case of Bangladesh. Politics and Religion, 12(2), pp. 257-282. https://doi.org/10.1017/S1755048318000573

৩. উন্নয়নের বয়ান নিয়ে আরো দেখুন, সাইমুম পারভেজ,  "শ্রমিকের সস্তা জীবন, মায়ের আহাজারি আর ধনীর ‘উন্নয়ন’", মতামত, প্রথম আলো, ২০ এপ্রিল ২০২১।

৪. Riaz, A & Parvez, S. Bangladesh at 50: The Transformation of a Nation. The Diplomat. March 01, 2021. https://thediplomat.com/2021/02/bangladesh-at-50-the-transformation-of-a-nation/

৫. প্রাগুক্ত, সাইমুম পারভেজ,  "শ্রমিকের সস্তা জীবন, মায়ের আহাজারি আর ধনীর ‘উন্নয়ন’

 

 

 

 

Your Comment