শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০ Friday 29th March 2024

শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

Friday 29th March 2024

বহুস্বর মতামত

চা শ্রমিকদের দুর্দশা তদন্তে স্বাধীন কমিশন গঠন করা হোক

২০২২-১০-২০

মিখা পিরেগু

মালিকরা বিভিন্ন সময়ে দাবি করে আসছেন, একজন চা শ্রমিক নাকি সব মিলিয়ে এখন যা যা সুবিধা পেয়ে থাকেন, তার দৈনিক মোট মূল্য নাকি ৫০০ টাকা। চা শ্রমিকদের মজুরি যখন ১২০ টাকা ছিল, তখনও তারা দাবি করতেন চা শ্রমিকরা যে সব সুবিধা পান, তার মোট মূল্য নাকি তখনকার বাজারমূল্যে ৪০২ টাকা ছিল। কিভাবে চা শ্রমিকদের এই কল্পিত “বিশাল” মজুরিটা নির্ধারণ করা হয়, আসলে এই সব সুযোগ সুবিধার প্রকৃত চিত্রটা কী, এবং প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় নিয়েই আজকের এই লেখা।   

 

 

জরাজীর্ণ ঘরের সামনে সন্তানদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন হতদরিদ্র চা শ্রমিক

 

 

দৈনিক মজুরির ফাঁকি!

৩০০ টাকা মজুরি নির্ধারণের দাবিতে দীর্ঘ ১৯ দিন চা শ্রমিক ধর্মঘটের পর চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি শেষ পর্যন্ত ১৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ২৭ আগস্ট গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চা-বাগান মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) বৈঠকের পর এ ঘোষণা আসে। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস গণভবন গেটে সাংবাদিকদের এ কথা জানান। আহমদ কায়কাউস বলেন, মজুরি নির্ধারণের পাশাপাশি বার্ষিক ছুটি, বেতনসহ উৎসব ছুটি আনুপাতিক হারে বাড়বে। অসুস্থতাজনিত ছুটি বাড়ানো হবে। চিকিৎসা ব্যয়ের চাঁদা মালিকপক্ষ বহন করবে। ভবিষ্যৎ তহবিলে নিয়োগকর্তার চাঁদা আনুপাতিক হারে বাড়বে। এছাড়া ভর্তুকি মূল্যে রেশন সুবিধা বাড়ানো হবে। চিকিৎসা সুবিধা, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের পেনশন, চা শ্রমিকদের পোষ্যদের শিক্ষাবাবদ ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ, গোচারণভূমি বাবদ ব্যয়, বিনামূল্যে বসতবাড়ি ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ শ্রমিক কল্যাণ কর্মসূচিতে বরাদ্দ প্রভৃতি বাড়বে। সব কিছু মিলিয়ে দৈনিক মজুরি সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মতো পড়বে!

 

দেশের প্রচলিত আইনেই চা শ্রমিকদের মজুরি বিষয়ে বাগান মালিকদের এই দাবি আইন পরিপন্থী এবং ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ ও শ্রম বিধিমালা ২০১৫ পর্যালোচনা করলেই বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যায়।   

 

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের এই বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে চা শ্রমিকদের নগদ মজুরি ও সেবার ব্যাপারে বাগান মালিকেরা যা দাবি করেন সরকার সেটা বিশ্বাস করেন। বাগান মালিকদের দাবি দৈনিক মজুরির বাইরে একজন চা-শ্রমিক বিভিন্ন সেবা পেয়ে থাকেন যা আর্থিক অংকে নগদ মজুরির সাথে যোগ করে দেখানো হয়। যার ভেতর রয়েছে (মাঠ ও কারখানা) ঘর ভাড়া ছাড়াও ভর্তুকি মূল্যে রেশন (প্রতি কেজি ২ টাকা দরে) সরবরাহ বাবদ ব্যয় (চাল ও আটার গড়) ৩০.৭১ টাকা, চিকিৎসা সুবিধা ৭.৫০ টাকা, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের পেনশন বাবদ ২ টাকা, ধানক্ষেতের জন্য ভূমি উন্নয়ন কর / ইজারা মূল্য পরিশোধ বাবদ ০.১০ টাকা, চা-শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষা বাবদ ব্যয় ১.৫০ টাকা, রক্ষণাবেক্ষণ, গরু চড়ানো, চৌকিদার প্রভৃতি বাবদ ব্যয় ১ টাকা, শ্রমিক গৃহের জন্য ব্যবহৃত জমি বাবদ ভূমি উন্নয়ন কর/ ইজারা মূল্য ০.০২ টাকা, শ্রমিক কল্যাণ কর্মসূচি (গৃহ মেরামত, বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক স্প্রে, পয়ঃনিষ্কাশন, পাতি গামছা সরবরাহ, ছুপি সরবরাহ, ছাতা সরবরাহ, জ্বালানি কাঠ, পূজা, খেলাধুলা, বিনোদন, পণ্ডিত, শেষকৃত্য, প্রভৃতি বাবদ ৪৩ টাকা এবং বাসাবাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল প্রভৃতি বাবদ আয় ১৪ টাকাসহ মোট ১৭৬.৭৫ টাকার সুযোগ-সুবিধা পান। অর্থাৎ মজুরি এবং দ্রব্য ও সেবার সুবিধাসহ একজন মাঠ পর্যায়ের শ্রমিক দৈনিক ৩৭১.৮৮ টাকা এবং মাঠ পর্যায়ের শ্রমিক ৪০২.৮৮ টাকা পান বলে বাগান মালিকদের দাবি।

 

দেশের প্রচলিত আইনেই চা শ্রমিকদের মজুরি বিষয়ে বাগান মালিকদের এই দাবি আইন পরিপন্থী এবং ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ ও শ্রম বিধিমালা ২০১৫ পর্যালোচনা করলেই বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যায়।   কয়েকটি প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্ত আমরা এখানে দিচ্ছি।

 

১. সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাগান উদ্যোক্তারা দাবি করেছেন, চা উত্তোলনের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই, সেক্ষেত্রে একজন শ্রমিক দৈনিক কর্মঘণ্টার মধ্যে অতিরিক্ত পাতা উত্তোলনের জন্য বোনাস পেয়ে থাকেন, যা বাগান ভেদে গড়ে দৈনিক ৬৫ টাকা হয়। এটি শ্রমিকের অতিরিক্ত কাজের টাকা।

 

অথচ, শ্রম আইনের ১০৮ (১) ধারা অনুযায়ী, অতিরিক্ত কাজের জন্য দ্বিগুণ মজুরির কথা উল্লেখ আছে এবং এটা দৈনিক মজুরিতে যুক্ত হবে না।

 

২. ছুটির দিনে কাজ করালে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে তা শ্রম আইনের একটি সাধারণ বিষয়। শ্রম আইন ২০০৬ এর ১১৭ এর ১(খ) ধারা অনুযায়ী, শ্রমিকরা প্রতি ২২ দিনে একদিন ছুটি পাবেন। তাই এই ছুটির দিনে পাওয়া টাকা দৈনিক মজুরিতে যুক্ত হবে না।

 

৩. বেতনসহ উৎসব ছুটির শ্রম আইন ২০০৬ এর ১১৮(১) ধারা অনুযায়ী প্রতি শ্রমিককে ১১ দিনের ছুটির টাকা প্রদান করতে মালিকপক্ষ বাধ্য থাকবে।

 

৪. ভবিষ্যৎ তহবিলে নিয়োগকর্তার চাঁদার বিষয়ে শ্রম আইন ২০০৬ এর ২(৪৫) এর খ ধারা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ তহবিলে নিয়োগকর্তার চাঁদা মূল মজুরিতে অন্তর্ভুক্ত হবে না। এই চাঁদার ৫ শতাংশ আবার প্রশাসনিক খরচ, প্রশাসনিক খরচ কেন শ্রমিক দেবে?

 

৫. চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে একজন পুরুষকে ৩ দশমিক ২৭ কেজি, পোষ্য নারীকে ২ দশমিক ৪৪ কেজি, শিশুকে ১ দশমিক ২২ কেজি হিসেবে মোট ৬ দশমিক ৯৩ কেজি আটা দেওয়া হয়। নারী শ্রমিকের পোষ্য রেশন নেই। অথচ নারী শ্রমিকই প্রধান শ্রমিক। তিনি অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়। এছাড়া, ধানী জমি থাকলে রেশন দেওয়া হয় না। আর তাছাড়া মালিকপক্ষের দাবির তুলনায় রেশন অনেক কম ও নিম্নমানের।

 

৬. শ্রম আইনের ৯৫(গ) ধারায় চা জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত চিকিৎসাকেন্দ্রের ব্যাপারে উল্লেখ থাকলেও প্যারাসিটামল, নাপা, স্যালাইন ছাড়া উন্নতমানের কোনো চিকিৎসা সুবিধা নেই। তবে কোম্পানি ভেদে কিছুটা তারতম্য হয়ে থাকে।

 

৭. অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের পেনশনের বিষয়ে শ্রম আইন ২০০৬ এর ২(৪৫) এর খ অনুযায়ী পেনশনের টাকা মূল বেতনের সঙ্গে যুক্ত হবে না।

 

৮. ধানক্ষেতের জন্য ভূমি উন্নয়ন কর/ইজারা মূল্য পরিশোধের ব্যাপারে উল্লেখ করা দরকার যে, ধানী জমি খুবই নগণ্য সংখ্যক চা-শ্রমিকের আছে।

 

৮. চা-শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষার বিষয়ে শ্রম আইনের ৯৫ ধারায় বলা আছে “সরকার চা বাগান সম্পর্কে- (ক) বিধি প্রণয়ন করিয়া উহার প্রত্যেক মালিককে সেখানে নিযুক্ত শ্রমিকগণ এবং তাহাদের শিশু সন্তানগণের জন্য বিধিতে উল্লিখিত বিনোদনমূলক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার জন্য নির্দেশ দিতে পারিবে; (খ) যেক্ষেত্রে কোন চা-বাগানের শ্রমিকগণের ছয় হইতে বারো বছর বয়সী শিশু সন্তানগণের সংখ্যা পঁচিশ এর উপরে হয় সেক্ষেত্রে, বিধি প্রণয়ন করিয়া উহার মালিককে, বিধিতে উল্লিখিত প্রকারে এবং মানের শিশুদের শিক্ষার সুযোগ এর ব্যবস্থা করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারিবে”।

 

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিটি চা বাগানে ভাঙা প্রাইমারি স্কুলঘর। পর্যাপ্ত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক ও প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই। শিক্ষা সুবিধা শুধু প্রাইমারি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। অনেক বাগানে তাও নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চা বাগানে নেই।

 

শ্রমিকদের যথাযথ প্রতিনিধিদের কথা বলবার সুযোগ দেয়া হলে এই বিষয়গুলো নিশ্চিতভাবেই উঠে আসত। কিন্তু আইন ও যুক্তিসঙ্গত এই সকল আলোচনাকে আদৌ উঠতেই দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি মালিকপক্ষের সাথে সরকারের একতরফা সভায়।

 

৯. চা জনগোষ্ঠীর গৃহায়ন সুবিধার ব্যাপারে শ্রম আইনের ৯৬ ধারায় বলা আছে, প্রত্যেক চা বাগানের মালিক চা বাগানে বসবাসরত প্রত্যক শ্রমিক এবং তাহার পরিবারের জন্য গৃহায়নের সুবিধার ব্যবস্থা করিবেন।

অথচ বাস্তবতা বলছে, বসতবাড়ি নির্মাণের জন্য বাগান কর্তৃপক্ষ প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই কোনো আর্থিক সহযোগিতা করে না ফলে শ্রমিক পরিবার একটি আধাকাঁচা ঘরে গবাদিপশু ও শিশুসন্তানসহ বসবাস করে। 

 

১০. রক্ষণাবেক্ষণ, গরু চড়ানো, চৌকিদার প্রভৃতি বাবদ ব্যয়ের অর্থ হিসাবে এনে মজুরি হিসাবে দেখানো মালিকপক্ষের মানসিক দৈনতার বহিঃপ্রকাশ। উল্লেখ্য, একজন চৌকিদারও ১২০ টাকা মজুরিপ্রাপ্ত শ্রমিক।

১১. শ্রমিক কল্যাণ কর্মসূচির বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক স্প্রে, পয়ঃনিষ্কাশন, বিনোদন, পণ্ডিত, শেষকৃত্য প্রভৃতির ক্ষেত্রে কোনো খরচ দেয়া হয় না। পাতি গামছা, চুপি ও ছাতা বছরে একবারই সরবরাহ করা হয়। এগুলো রীতিমত চা আহরণ কাজের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। এ সকল খরচ মালিকপক্ষেরই দেয়ার কথা এসব উপকরণ ব্যয় শ্রমিক কেন দেবে? কোনো কারখানায় নিরাপত্তা উপকরণ বা কাজের সময়ে ব্যবহার্য কোনো অত্যাবশ্যকীয় পোশাক কি শ্রমিক প্রদান করেন?

 

 

শ্রমিকের সম্মতি ছাড়াই চা শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ

শ্রমিকদের যথাযথ প্রতিনিধিদের কথা বলবার সুযোগ দেয়া হলে এই বিষয়গুলো নিশ্চিতভাবেই উঠে আসত। কিন্তু আইন ও যুক্তিসঙ্গত এই সকল আলোচনাকে আদৌ উঠতেই দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি মালিকপক্ষের সাথে সরকারের একতরফা সভায়।

 

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দীর্ঘসময় ধরে অর্ধাহারে অনাহারে চা শ্রমিকেরা আন্দোলন করলেও প্রধানমন্ত্রী দেখা করলেন মালিকপক্ষের সাথে। মজুরি নির্ধারনের ক্ষেত্রে চা শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ মতামত দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। একপাক্ষিক মতামতের ভিত্তিতে আবারও একটি অন্যায্য মজুরি চা শ্রমিকদের উপর চাপিয়ে দেয়া হল। এদিকে চা- বাগান মালিকদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, করোনাকালীন সময়ে সকল ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। এখানে উল্লেখ বিষয় যে, করোনার সময়ে সকল শিল্প কারখানা বন্ধ থাকলেও চা বাগানগুলোত একটি দিনের জন্যও লকডডাউন ছিল না। উচ্চ স্বাস্থঝুঁকি নিয়েও চা শ্রমিকরা কাজ করেছেন।

 

 

মজুরি নির্ধারণ প্রক্রিয়ার জুলুম

প্রতি দুই বছর অন্তর চা শ্রমিকদের মজুরি যে প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত হয় সেটি মূলত একটি বেআইনি প্রক্রিয়া অর্থাৎ বিধিসম্মত নয়। নূন্যতম মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারনের কথা থাকলেও চা শিল্প সেক্টরে মালিক আর শ্রমিকদের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে মজুরি নির্ধারিত হয়। এটাকে বলা হয় ‘মেমরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার- ১৩১ নং কনভেনশনে বলা হয়েছে, “সর্বনিম্ন মজুরি অবশ্যই আইন দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিক ও তার পরিবারের প্রয়োজন, জীবনযাত্রা ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা ইত্যাদিকে বিবেচনায় নিয়ে নূ্ন্যতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।” বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে - ‘প্রত্যেক কর্মীর নিজের ও পরিবারের মানবিক মর্যাদা সম এমন ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে নাগরিকদের যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার বিষয়টি রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে বলা হয়েছে। অথচ শ্রমিকদের মজুরি সংক্রান্ত এরূপ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কিংবা আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র যার অনুস্বাক্ষরকারী হয়েও এই রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে চা শ্রমিকদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে।

 

জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লে এটা যেমনি মন্ত্রী-এমপি-আমলাদের জীবনমানকে প্রভাবিত করে তেমনি চা শ্রমিকদেরও প্রভাবিত করে। কিন্তু সরাসরি উৎপাদনশীলতার সাথে যুক্ত থেকেও চা শ্রমিকদের মজুরি শুধু হতাশাজনক নয় বরং লজ্জারও।

 

বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। কীভাবে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন হবে, কীভাবে কাজ করবে, কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে এবং কতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করবে, সবই সেখানে বলা হয়েছে। নূন্যতম মজুরি বৃদ্ধি করার পিছনে জীবনযাত্রার খরচ, শ্রমিকের এবং তার পরিবারের চাহিদা, উৎপাদনের খরচ, উৎপাদনশীলতা, পণ্যের দাম, ভোক্তামূল্য দিতে নিয়োগকারীদের ক্ষমতা, দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা, মুদ্রাস্ফীতির হার ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে থাকে। কিন্তু চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এগুলোকে কখনোই বিবেচনায় নেয়া হয় না। 

 

বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি কর্মকর্তাদের বেতনও দ্বিগুণ হয়েছে। সরকারি কারখানা শ্রমিকেরও বেতন দ্বিগুণ বেড়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লে এটা যেমনি মন্ত্রী-এমপি-আমলাদের জীবনমানকে প্রভাবিত করে তেমনি চা শ্রমিকদেরও প্রভাবিত করে। কিন্তু সরাসরি উৎপাদনশীলতার সাথে যুক্ত থেকেও চা শ্রমিকদের মজুরি শুধু হতাশাজনক নয় বরং লজ্জারও। অধিক মজুরি সরাসরি উৎপাদনশীলতাকেই ত্বরান্বিত করতে পারে। চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়লে রাষ্ট্রেরই সুবিধা বেশি কারণ তারা দেশের টাকা দেশে খরচ করবে। বিভিন্ন সেক্টরভিত্তিক নূন্যতম মজুরি বোর্ড ক্রিয়াশীল ভূমিকা রাখলেও চা সেক্টরে গতবার নূন্যতম মজুরি বোর্ড গঠিত হলেও কার্যত নিস্ক্রিয় ছিল। তাই চা শ্রমিকের এই ১৭০ টাকার বর্তমান মজুরি প্রহসনমূলক এবং বর্তমান বাজারদরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। চা শ্রমিকদের সংগ্রাম চলছে অন্যথায় চা শ্রমিকেরা এই শ্রমদাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাবে না।

 

 

চা শ্রমিকদের অবস্থার মূল্যায়নে স্বাধীন একটা কমিশন গঠন করা হোক

চা শ্রমিকরা রাস্তায় নেমেছিলেন বলেই তাদের দুর্দশার দিকে সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা যেভাবে দমন-পীড়ন-ভীতি- প্রদর্শন ও লোভকে উপেক্ষা করে তাদের আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন, তা সংগ্রামের নতুন দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছে। আরও অসাধারণ একটি বিষয় হল, ধর্ম, বর্ণ, মতবাদ নির্বিশেষে সারা দেশের প্রায় সকল মানুষ যেভাবে চা শ্রমিকদের দাবির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, সেটাও বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা।

 

কিন্তু সর্বশেষ মজুরি বৃদ্ধির পর চা শ্রমিকদের দুর্দশা আসলে কতটুকু কমেছে বা বেড়েছে? বাজারে মুদ্রাস্ফীতি এখন প্রায় দুই অংকে বেড়েছে। বাজারে সকল খাদ্যপণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে গত দুই বছরে। মাসে মাসে নয়, সপ্তাহে সপ্তাহে দাম বেড়েছে। চা শ্রমিকরা যখন আন্দোলন শুরু করেছেন, তখনকার তুলনায় অবস্থা এখন বহুগুণ বেশি খারাপ হয়েছে।

 

ফলে ১৭০ টাকার যে মজুরি মালিকদের সাথে মিলে সরকার নির্ধারণ করেছেন, তা শ্রমিকদের জন্য একবারেই পর্যাপ্ত নয়। বরং এই মুহূর্তে আন্দোলনটা শুরু হলে শ্রমিকরা নিশ্চিতভাবেই ৩০০ টাকারও বেশি মজুরিই দাবি করতেন। যেটুকু মজুরি বৃদ্ধি হয়েছে, তা ইতিমধ্যেই মুদ্রাস্ফীতি খেয়ে ফেলেছে।

 

চা শ্রমিকদের পরিস্থিতি নিয়ে তাই একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করাটা জরুরি। শ্রমিকদের বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে মালিকরা যে দাবিগুলো করে থাকেন, তা কতদূর সত্যি, সেটা যেমন এই কমিশন বিবেচনা করবে, তেমনি একটি বাগানের সার্বিক আয় ব্যয়ের হিসেব সাপেক্ষে শ্রমিকের মজুরি কত হলে তা গ্রহণযোগ্য হয়, সেটাও ওই কমিশন দেখবে। সৎ ও গ্রহণযোগ্য অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, বিচারপতি, সাংবাদিক ও ব্যক্তিত্বদের নিয়ে এমন একটা কমিশনকে শ্রমিকরা আন্তরিকভাবেই স্বাগত জানাবে।

 

সর্বশেষ মজুরি বৃদ্ধির পর গণমাধ্যমে চা শ্রমিকদের নিয়ে সংবাদ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রান্তিক অঞ্চলে থাকেন বলে তাদের ওপর গণমাধ্যমের আলো কম; বাজারের উচ্চমূল্য তাদেরকে যেভাবে শোষণ করছে, তার কোনও প্রতিফলন তাই পত্রপত্রিকায় আমরা দেখতে পাই না। গ্রহণযোগ্য একটি কমিশন চা শ্রমিকদের বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে মালিক-শ্রমিক-স্থানীয় অধিবাসী সকলের মতামতের সাপেক্ষে পর্যালোচনা প্রতিবেদন তৈরি করলে শ্রমিকরা সেটা আন্তরিকতার সাথেই গ্রহণ করবেন। কিন্তু তেমন উদ্যোগ না নেয়া হলে মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতির নামে গরিব মানুষকে শোষণের ফাঁদ অব্যাহত রাখলে চা শ্রমিকরা আবারও হয়তো মাঠে নামতে বাধ্য হবেন।

 

 

 

মিখা পিরেগু
যুগ্ম সদস্য সচিব, চা শ্রমিক-ছাত্র-যুব মঞ্চ
সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন

Your Comment