মঙ্গলবার ৩রা বৈশাখ ১৪৩১ Tuesday 16th April 2024

মঙ্গলবার ৩রা বৈশাখ ১৪৩১

Tuesday 16th April 2024

বহুস্বর মতামত

৪০০ একর জমি, লামায় ম্রো-ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী আর আধুনিক জমিদারগণ

২০২৩-০১-০৩

থুইক্যসিং মারমা

৪০০ একর জমি, লামায় ম্রো-ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী আর আধুনিক জমিদারগণ

 

বান্দরবানের লামা উপজেলার একটি গ্রামে গতকাল অন্তত এক ডজন বাড়িতে হামলা ও লুটপাট করা হয়েছে। হামলার শিকার পরিবারগুলো প্রচণ্ড শীতে খোলা আকাশের নিচে আগুন জ্বেলে রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, তাঁদেরকে এলাকা থেকে তাড়াতে এ কাজ করেছে একটি রাবার বাগানের লোকজন।

অনেকের হয়ত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি মনে আছে। এই কবিতাটি এখন অষ্টম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কবিতায় জমিদার হতদরিদ্র কৃষক উপেনের শেষ সম্বল দুই বিঘা জমি কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেন।

 

শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।

বাবু বলিলেন, “বুঝেছ উপেন? এই জমি লইব কিনে।”

কহিলাম আমি, “তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই-

চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।”

 

উপেন তাঁর সপ্ত পুরুষের ভিটেমাটি বিক্রির প্রস্তাবে রাজি না হলে জমিদার মিথ্যা মামলায় ডিক্রি নিয়ে উক্ত জমি কেড়ে নেন। ফলে উপেন নিজ জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে সর্বহারায় পরিণত হন।

 

বর্তমান বাংলাদেশে আগের সেই জমিদারি প্রথা আর নেই। ১৯৫০ সালের জমিদারি উচ্ছেদ ও প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে এই প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের এক ভিন্ন জগত পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন নতুন করে জমিদারি ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে। এখানে এই একবিংশ শতাব্দীতে ‘জমিদাররা’ খাজনা-খাদক নয়, তারা হলো সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী এবং এমনকি রূপালী পর্দার নায়ক। এই আধুনিক জমিদারদের দৌর্দণ্ড প্রতাপে ‘এ কালের উপেনরা’ আজ বড়ই অসহায়।

 

পার্বত্য চট্টগ্রামে এই নয়া জমিদারি ব্যবস্থার সূচনা হয় ১৯৮০ সালে, যখন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের নিজস্ব ভূমি ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে রাবার বাগান ও হর্টিকালচারের জন্য পাহাড়িদের সমষ্টিগত মালিকানাধীন জমি বহিরাগতদের কাছে লিজ দিতে শুরু করে। এক হিসেব মতে, ১৯৮০ সালের ২৭ মার্চ থেকে ২০০৭ সালের ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ১,৪০৭টি রাবার বাগান ও ৪৬৪টি হর্টিকালচারের জন্য ১,৮৭১টি প্লটে মোট ৪৬,৯৫২ একর জমি লিজ দেয়া হয়েছে। (সূত্র: পার্বত্য ভূমি সহায়িকা: পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও ভূমি অধিকার, ইজারা এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সমস্যা’, সম্পাদনা: মংসানু চৌধুরী, প্রকাশ: ২০২১, চাকমা রাজ কার্যালয়।) প্রধানত: বান্দরবান সদর, লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলিকদম এই চার উপজেলায় জমি লিজ দেওয়া হয়। লিজপ্রাপ্তদের মধ্যে গুটিকয় ছাড়া সবাই পার্বত্য চট্টগ্রামের অ-বাসিন্দা এবং তাঁদের অধিকাংশই ঢাকা ও চট্টগ্রামের। ১৯৮০-৯০ এর দশকে জমি লিজের নামে যে হরিলুট করা হয়েছে সে সম্পর্কে নানা মুখরোচক কাহিনী এখনও লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে। শোনা যায়, গিন্নীদের খুশি করতে কোন কোন ইউএনও সকল সরকারি নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে তাঁদের নামে জমি লিজ করিয়ে নিয়েছিলেন।

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতবেকও লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজসহ অনেক লিজ গ্রহীতার লিজ বাতিল বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য। এই চুক্তির ঘ খণ্ডে বলা আছে, ‘রাবার চাষের ও অন্যান্য জমি বরাদ্দ: যেসকল অ-উপজাতীয় ও অ-স্থানীয় ব্যক্তিদের রাবার বা অন্যান্য প্লান্টেশনের জন্য জমি বরাদ্দ করা হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে যাহারা গত দশ বছরের মধ্যে প্রকল্প গ্রহণ করেন নাই বা জমি সঠিক ব্যবহার করেন নাই সেসকল জমির বন্দোবস্ত বাতিল করা হইবে।’

 

বর্তমানে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে যে একটি কোম্পানি জমি নিয়ে ম্রো ও ত্রিপুরাদের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে সেই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররাও ঐ সময়ে (১৯৯৪-৯৫ সালে) জমি লিজ নিয়েছিলেন। কিন্তু অভিযোগ হচ্ছে কোম্পানির ৬৪ জন শেয়ারহোল্ডারের আলাদা আলাদাভাবে লিজপ্রাপ্ত জমির মোট পরিমাণ ১,৬০০ (এক হাজার ছয় শত) একর হলেও তাঁরা এর চাইতে বেশি জমি দখল করেছেন এবং আরও জমি জোর করে দখল করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। এর ফলে সেখানে ইতিমধ্যে অনেক পাহাড়ি তাঁদের জমি হারিয়েছেন এবং আরো অনেকে হারানোর পথে রয়েছেন। ঢাকায় ৫ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির নেতারা বলেছেন, তাঁদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে এবং জমির জন্য লড়াই করা ছাড়া তাদের আর অন্য কোন বিকল্প নেই।

 

লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ৪০০ একর জমি দখলের জন্য ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জুমভূমি পুড়িয়ে দেয়া, প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি সাধন করা, তাঁদের লাগানো বাগান ও গাছ কেটে দেয়া, তাঁদের পানির উৎস ঝিরিতে বিষ ঢেলে দিয়ে গ্রামবাসীদের হত্যার চেষ্টা, ভূমি রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মিথ্যা মামলা দেয়া, ভূমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরার উপর শারীরিক হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা, জমি ছেড়ে দেয়ার জন্য এলাকাবাসীকে হুমকি দেয়া, আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে উক্ত ৪০০ একর জমিতে বনজঙ্গল কেটে সাফ করা ইত্যাদি।

 

গত ২৬ এপ্রিল ম্রো-ত্রিপুরাদের বিস্তৃত জুমভূমিতে আগুন দিয়ে ক্ষেত, বাগান ও পরিবেশ ধ্বংস করায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে সারা দেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বান্দরবান জেলা পরিষদ ঘটনা তদন্তের জন্য ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। সরেজমিন তদন্ত শেষে কমিটি জানায় য়ে, তারা লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছেন। তদন্ত দলের আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক বলেন,

 

“কোম্পানির ‘বন্দোবস্তের শর্ত লঙ্ঘন করে ২৫ বছর পর জায়গা দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে পাহাড়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। তদন্তে রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের চুক্তি লঙ্ঘনের প্রমাণ মিলেছে।” (দেখুন: আজকের পত্রিকা, ajkerpatrika.com, ১৯ মে, ২০২২, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ‘দোষী’)। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে পরে বান্দরবান জেলা পরিষদ পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের কাছে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের লিজ বাতিলের সুপারিশ করে।

 

কিন্তু সরকার এই সুপারিশ আমলে নিয়েছে বলে মনে হয় না। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা তার প্রমাণ। জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কয়েকবার লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ও গ্রামবাসীদের মধ্যে সালিশ বৈঠকের আয়োজন করে। কিন্তু মধ্যস্থতাকারীরা কোম্পানির পক্ষাবলম্বন করায় তাদের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি। অপরাধী কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং গ্রামবাসীদেরকে অধিকাংশ জমি কোম্পানির  রাবার চাষের জন্য ছেড়ে দিতে চাপ দেয়া হয়, যা তাঁরা মেনে নেননি। বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার পান না, লামার এই ঘটনা তার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

 

এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের কার্যকলাপ কেবল বিতর্কিত নয়, তা চরম গণবিরোধী ও প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। সে কারণে কোম্পানিটির বিভিন্ন বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া আবশ্যক। আমাদের জানার অধিকার আছে কোম্পানির ৬৪ জন শেয়ারহোল্ডার যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জমির লিজ নিয়েছেন কিনা এবং তাঁদের লিজে বর্ণিত জমির চৌহদ্দির সাথে দখলকৃত জমির চৌহদ্দির মিল রয়েছে কিনা। অভিযোগ রয়েছে যে,  কোম্পানিটি লিজকৃত জমির চাইতে বহুগুণ জমি দখলে নিয়েছে। তাই বর্তমানে কত পরিমাণ জমি কোম্পানির দখলে রয়েছে তা সঠিকভাবে পরিমাপ করতে হবে। সর্বোপরি লিজ চুক্তিতে (কবুলিয়ত, দফা ১০) বলা আছে যে, লিজ প্রাপ্তির ৩ বছরের মধ্যে জমির দখল বুঝে নেয়া না হলে লিজ বাতিল হয়ে যাবে। তাই যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় যে, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ম্রো-ত্রিপুরাদের যে জুমভূমি দখল করতে চাইছে তা লিজকৃত জমির অংশ, তাহলেও তাদের সেই কাজ অবৈধ। কারণ কোম্পানিটি লিজ চুক্তির ২৭ বছরেও ওই জমি ব্যবহার করেনি।

 

 

এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতবেকও লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজসহ অনেক লিজ গ্রহীতার লিজ বাতিল বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য। এই চুক্তির ঘ খণ্ডে বলা আছে, ‘রাবার চাষের ও অন্যান্য জমি বরাদ্দ: যেসকল অ-উপজাতীয় ও অ-স্থানীয় ব্যক্তিদের রাবার বা অন্যান্য প্লান্টেশনের জন্য জমি বরাদ্দ করা হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে যাহারা গত দশ বছরের মধ্যে প্রকল্প গ্রহণ করেন নাই বা জমি সঠিক ব্যবহার করেন নাই সেসকল জমির বন্দোবস্ত বাতিল করা হইবে।’ ভূমি রক্ষা আন্দোলনের নেতা জুয়ামলিয়ান আমলাই ও সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা জানাচ্ছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৎকালীন সাংসদ প্রয়াত প্রমোদ মানকিন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকাকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন-এর নেতা-কর্মীরা অবৈধভাবে ইজারা ভূমি প্রদান ও শর্ত লঙ্ঘনকারী ইজারা গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন করলে ৫০০’র অধিক ইজারা প্লট তাৎক্ষণিকভাবে চুক্তিশর্ত লঙ্ঘনসহ সালামি টাকা প্রদান না করার কারণে বাতিলের আদেশ হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে বাতিলকৃত অধিকাংশ প্লট বাতিলের এক মাসের মাথায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পুনর্বহাল হয়ে যায়।’ (প্রাগুক্ত)

ম্রো-ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর জনগণ এক সময় লামার বিস্তৃত অঞ্চলে বসবাস করতেন। কিন্তু পাহাড়ে রাবার প্লান্টেশনের জন্য তাঁদের হাজার হাজার একর জুমচাষের জমি হাতছাড়া হয়ে যায়। তাঁদের ‘মরিবার মতো ঠাঁই’ ৪০০ একর জমিও এখন কেড়ে নেয়ার জন্য আধুনিক জমিদাররা মরিয়া হয়ে উঠেছে। লামার ক্ষতিগ্রস্তরা এবং আমরা সবাই ন্যায়বিচার চাই। সন্দেহ নেই লামা  রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের কর্তাব্যক্তিরা শক্তিশালী। কিন্তু তাঁরা এত ক্ষমতাশালী নন যে, সরকার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তাঁদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে ভয় পেতে পারে।

 

থুইক্যসিং মারমা

সাংগঠনিক সম্পাদক 
গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি

Your Comment