শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০ Friday 29th March 2024

শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

Friday 29th March 2024

দেশজুড়ে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ

আজ আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস

২০২২-০৯-০৩

জয়ন্তী রায়না

শকুন পাখিটির একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি আমাদের মানসপটে আছে। সাহিত্য বা নাটক-সিনেমায় শকুনকে উপস্থাপন করা হয়েছে হিংস্র, অশুভ প্রাণী হিসেবে। অনেক জায়গায় এমন কী অশুভ কোনো বিষয়ের প্রতীকী ছবি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে শকুন। এর কারণ, মানুষ সবসময় শকুনকে দেখেছে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে এসে মৃত প্রাণী খেতে। কিন্তু মৃত প্রাণী খাওয়াটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝতে বুঝতে পৃথিবী গ্রহ থেকে শকুনদের একটা বড় অংশ হারিয়ে গিয়েছে। শকুনদের রক্ষা করতে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবারটিকে “আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস” পালন করা হয়।

 

 

ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াতিতে উদ্ধার করা হয়েছে একটি হিমালয়ের শকুন। শীতকালে এই পাখিগুলো বাংলাদেশে আসার সময়ে

শ্রান্ত ও দুর্বল হয়ে মাটিতে নেমে আসে এবং প্রায়ই ক্ষুধার কারণে বা শত্রুর হাতে মৃত্যুবরণ করে। আলোকচিত্রী: অমল টুডু 

 

 

শকুন পরিচিত প্রকৃতির ঝাড়ুদার বা প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে। বিভিন্ন প্রাণী মারা যাওয়ার পর শকুন সেই মৃতদেহগুলো খায়, এমন কী হাড়গোড়ও গিলে খেয়ে ফেলে। কেবল এই একটিমাত্র কাজ করার মাধ্যমে শকুন জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সক্রিয় একটি ভূমিকা পালন করছে।

 

গরু-ছাগলসহ বিভিন্ন গবাদি পশু মারা যাওয়ার পর এই মৃতদেহগুলো প্রকৃতির জন্য নানান হুমকি তৈরি করে। মৃত প্রাণী থেকে গন্ধ ছড়ানো তো বটেই, সেই সাথে এগুলো থেকে রোগ জীবাণু সংক্রমণেরও আশঙ্কা থাকে। কারণ প্রাণী মারা গেলেও তার শরীরে থাকা রোগ জীবাণু প্রকৃতিতে থেকে যায়। একসময় অ্যানথ্রাক্স নামের রোগে অনেক গবাদি পশু মারা যেত। এই অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু প্রাণী মাটিতে পুঁতে ফেলার পরেও ১০০ বছর পর্যন্ত অন্য প্রাণীকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা রাখে। অনেক সময় মৃত প্রাণীর দেহ পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। তখন সেই মৃতপ্রাণীর রোগজীবাণু পানিতে ছড়িয়ে অন্যান্য প্রাণীর জন্যেও তা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। আরও বিপদজনক বিষয় হলো বহুক্ষেত্রেই এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে ছড়িয়ে যাওয়া অসুখ মহামারী আকারে দেখা দেয়, কারণ নতুন প্রাণীটির সাধারণত ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে কোনও প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না।

 

শকুনের পাকস্থলীতে থাকা শক্তিশালী এসিড অ্যানথ্রাক্সসহ অধিকাংশ জীবাণুকে ধ্বংস করতে পারে। তাই শকুন যখন রোগাক্রান্ত মৃত প্রাণী খায়, তা ওই জীবাণুগুলোকে প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এভাবে অনেক সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে থাকে। একারণেই শকুনকে তার কাজটি করতে দেওয়াটাই মৃত প্রাণীকে সৎকারের সবচেয়ে ভালো উপায়। 

 

শকুনের পাকস্থলীতে থাকা শক্তিশালী এসিড অ্যানথ্রাক্সসহ অধিকাংশ জীবাণুকে ধ্বংস করতে পারে। তাই শকুন যখন রোগাক্রান্ত মৃত প্রাণী খায়, তা ওই জীবাণুগুলোকে প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এভাবে অনেক সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে থাকে। একারণেই শকুনকে তার কাজটি করতে দেওয়াটাই মৃত প্রাণীকে সৎকারের সবচেয়ে ভালো উপায়।

 

এতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি তো না-ই, বরং উপকার হয়। এছাড়া মৃত প্রাণী ফেলে দিলে তো বটেই, মাটিচাপা দিলেও রোগজীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা থেকেই যায়। কুকুর, শেয়াল এবং অন্যান্য কিছু মাংশাসী স্তন্যপায়ী প্রাণী প্রায়ই মাটি খুড়েও শবদেহ খেয়ে থাকে। এভাবে জলাতঙ্ক ছড়াতে পারে। এমন কী মৃতপ্রাণী পোড়ালেও তা নির্গত করে ক্ষতিকর কার্বন। অন্যান্য কিছু প্রাণী মৃত প্রাণী খেলেও, শকুনের মতো তারা জীবাণু ধ্বংস করতে পারে না। বরং রোগাক্রান্তও হতে পারে।

 

একসময় শকুনের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, মানুষের কাছে একরকম উপদ্রবের মতো ছিল এই পাখি। সেই কারণেই হয়তো প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শকুনের ভূমিকা নিয়ে বা শকুনের সংরক্ষণ নিয়ে মানুষকে খুব বেশি ভাবতে হয়নি। সত্তর-আশির দশকেও শকুনের সংখ্যা সন্তোষজনক ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে একসময় লাখ লাখ শকুন ছিলো। অথচ বর্তমানে ভারতে শকুনের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১১ হাজারে। বাংলাদেশে গত দুই/ তিন দশকে শকুনের সংখ্যা কমেছে ৯৯.৯৯%। এখন বাংলাদেশে শকুনের সংখ্যা মাত্র প্রায় ২৬০টি। নেপালে বর্তমানে রয়েছে ৯টি প্রজাতির শকুন, যার মধ্যে ৫টি প্রজাতিই বিপন্ন।

 

শকুনের বংশবিস্তারের আরও কিছু প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা আছে। শকুন প্রতি দুই বছরে মাত্র একবার ডিম পাড়ে। সে কারণে সেই ডিম কোনোভাবে নষ্ট হয়ে গেলে শকুনের সংখ্যা বাড়ানো মুশকিল।

 

নব্বই এর দশকের দিকে কমতে শুরু করে শকুনের সংখ্যা। এই বিষয়টি প্রথম নজরে আসে ভারতের পারসিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে। পারসি সম্প্রদায়ের মানুষেরা জল, মাটি, বায়ু এই তিনটিকেই পবিত্র মনে করায় তাঁরা পরিবেশকে দূষিত করেন না। এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা এক প্রাণীর জন্য আরেক প্রাণীর দেহদান করাকে একটি পবিত্র বিষয় মনে করেন। তাই কেউ মারা গেলে তাঁকে সৎকার না করে রেখে আসেন উঁচু খোলা একটি স্থানে, যাকে বলে টাওয়ার অফ সাইলেন্স। সেখানে রেখে আসার পর শকুন এসে সেই মৃতদেহগুলো খেয়ে যায়। মুম্বাইয়ের মালাবার হিলে, এমনকী কলকাতাতেও ছিল পারসিকদের এই মৃতদেহ সৎকারের স্থান।


২০০৩ সালে পারসি একজন নারী টাওয়ার অফ সাইলেন্স এর কিছু ছবি প্রকাশ করেন, যেখানে দেখা যায় সেখানে মৃতদেহের স্তুপ পড়ে আছে। অথচ এখানে এই দৃশ্য খুবই অস্বাভাবিক। মৃতদেহ রেখে যাওয়ার পরে তা পরিষ্কার করে ফেলা শকুনদের জন্য ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার। এই ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রথম মানুষের নজরে আসে যে শকুনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।

 

২০০৩ সালে পারসি একজন নারী সৎকারের জায়গাটির কিছু ছবি প্রকাশ করেন, যেখানে দেখা যায় সেখানে মৃতদেহের স্তুপ পড়ে আছে। অথচ এখানে এই দৃশ্য খুবই অস্বাভাবিক। মৃতদেহ রেখে যাওয়ার পরে তা পরিষ্কার করে ফেলা শকুনদের জন্য ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার। এই ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রথম মানুষের নজরে আসে যে শকুনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।

 

কেবল ভারতেই না, অন্যান্য দেশেও শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করেন বিশেষজ্ঞরা।

 

এরপর শুরু হয় শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ খোঁজার পালা। প্রথমদিকে জলবায়ু পরিবর্তন বা তেজস্ক্রিয়াকে কারণ মনে করা হলেও গবেষকরা যখন মৃত শকুনের দেহ ব্যবচ্ছেদ করা শুরু করেন, তখন অন্য বিষয় সামনে আসে। তারা দেখতে পান শকুনগুলো মারা যাচ্ছে ফুসফুস যকৃতের বিষক্রিয়ায়। এর জন্য দায়ী ডাইক্লোফেনাক নামের এক ওষুধ।

 

ডাইক্লোফেনাক ওষুধের পেটেন্ট হয় ১৯৯০ এর শুরুর দিকে। দামে সস্তা এই ওষুধ ব্যাথানাশক হিসেবে খুবই কার্যকর। দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি গবাদিপশুর ওপর অনেক দিক থেকে নির্ভরশীল। যেই কারণে প্রাণীর ব্যাথানাশক হিসেবে এই ডাইক্লোফেনাক ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। দক্ষিণ এশিয়া ছিল এই ওষুধের বিশাল মজুদ। কিন্তু এই ওষুধই প্রাণীজগতের আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী শকুনকে বিপন্ন হওয়ার পথে ঠেলে দেয়। ডাইক্লোফেনাক শরীরে প্রবেশ করানো কোনও প্রাণী পেটে গেলে ৩দিনের মধ্যে মারা যায় শকুন। এই ওষুধ আসার পরেই মূলত শকুনের সংখ্যা কমতে শুরু করে।

 

এছাড়া অনেক সময় কুকুরকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়। কুকুরের মৃতদেহ গবাদি পশুর মতই শকুনের অন্যতম প্রধান খাদ্য। বিষক্রিয়ায় মারা যাওয়া কুকুর খেয়েও শকুন মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে।

 

ডাইক্লোফেনাক শকুনের বিপন্ন হওয়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করলে আরও কিছু বিষয় এর পিছনে কাজ করে। পুরনো ও বড় গাছ কেটে ফেলায় শকুন পড়েছে বাসস্থান সংকটে। শকুনেরা বাস করে উঁচু গাছে। রেইনট্রি, কড়ই, শিমুল, শেওড়া, তাল এই গাছগুলো মূলত শকুনের আবাসস্থল। বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় যত দিন যাচ্ছে শকুনের আবাসস্থল কমছে।

 

 

উদ্ধার হওয়া একটি হিমালয়ী শকুন। আলোকচিত্রী: ফিরোজ আল সাবাহ্

 

 

আরও নানান কারণে শকুনের খাবারের জোগানও কমছে। মানুষ যখন গরু বা ছাগলের ভুঁড়ি খেত না, সেগুলো ছিল শকুনের খাদ্য। এরপরে মানুষ যখন ভুঁড়ি খেতে শুরু করে, তখন টান পড়ে শকুনের খাবারে। আবার মানুষের পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বা পরিবেশের ধরন পরিবর্তিত হওয়ার কারণে মানুষ এখন মৃত পশু ভাগাড়ে না ফেলে তা মাটিচাপা দেওয়া শুরু করে। মাটিচাপা দেওয়ায় শকুনের আর সেই খাবার খাওয়ার সুযোগ থাকে না।

 

কিন্তু শকুনের এই হারিয়ে যাওয়া পরিবেশের জন্য তো বটেই, মানুষের বেঁচে থাকার জন্যেও হুমকিস্বরূপ। কারণ প্রাণীজগতের সব প্রাণীই বেঁচে থাকার জন্য একজন আরেকজনের ওপর নির্ভরশীল। কোনও একটি প্রাণী বিপন্ন হতে থাকলে তা প্রভাব ফেলে সমস্ত জীবজগতে।

 

শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বাড়ছে জলাতঙ্ক ও অ্যানথ্রাক্স রোগ। কারণ শকুন না থাকায় এই রোগগুলোর জীবাণু প্রকৃতিতে বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে আরও অনেক রোগের সংক্রমণেরও পরোক্ষ কারণ শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়া। ভারতে এই রোগের পরিমাণ বেড়েছে শতকরা ৩০ ভাগ। ৭ হাজারের বেশি মানুষ প্রতি বছর মারা যাচ্ছে এইসব রোগে।

 

শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বাড়ছে জলাতঙ্ক ও অ্যানথ্রাক্স রোগ। কারণ শকুন না থাকায় এই রোগগুলোর জীবাণু প্রকৃতিতে বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে আরও অনেক রোগের সংক্রমণেরও পরোক্ষ কারণ শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়া। ভারতে এই রোগের পরিমাণ বেড়েছে শতকরা ৩০ ভাগ। ৭ হাজারের বেশি মানুষ প্রতি বছর মারা যাচ্ছে এইসব রোগে।

 

শকুন রক্ষার উদ্যোগ নিয়ে ২০১২ সালে বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত ও পাকিস্তান মিলে জোট তৈরি করে। এই জোট শকুন রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।

 

নেপালের কাওয়াসাটি নাওয়াল পারসি গ্রামে শকুনদের জন্য রয়েছে জটায়ু ভোজনালয়। এই ভোজনালয়ে শকুনদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। যখন কোনও বয়স্ক গরু মারা যায়, তাকে একে ফেলা হয় এইখানে আর শকুনেরা এইখানে এসে ক্ষুধা মেটায়। নেপালে এরকম ভোজনালয় আরও রয়েছে নওলাপারসি, রূপনদেহি ড্যাং, কৈলালী, কাসকি এবং সুনসারি জেলায়। গ্রামবাসীদের অংশগ্রহণে চলে এই উদ্যোগগুলো, তাঁরাই নির্দিষ্ট স্থানে শকুনের জন্য ফেলে আসেন মৃত গবাদি পশু। এই উদ্যোগের কারণে নেপালে এখন শকুনের সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়ছে।

 

ভারতে গরুকে পবিত্র প্রাণী মনে করে খাওয়া হয় না, যে কারণে ভারতে শকুনের খাবারের জোগান দেওয়া সহজ। ভারতও শকুনদের জন্য তৈরি করেছে ভোজনালয়। সকালবেলা সেখানে গরু ফেলা হয় শকুনদের খাওয়ার জন্য। হিমাচল প্রদেশের পিনজরে রয়েছে শকুনের প্রজননকেন্দ্র। ৬ টি শকুন প্রজননকেন্দ্রে ৬০০ এর বেশি শকুন রয়েছে। ডাইক্লোফেনাক নামের ক্ষতিকর ওষুধ ভারত নিষিদ্ধ করে ২০০৬ সালে। শকুনদের খাদ্যচাহিদা পূরণে এবং নিরাপদ খাদ্য জোগান নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে দেশটি। সেই সাথে শকুনের আবাসাস্থল নিশ্চিত করতে বনায়নের দিকেও নজর দিচ্ছে।

 

বাংলাদেশে থাকা ৭ টি প্রজাতির মধ্যে বাংলা শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরু-ঠুঁটি শকুন ও রাজ শকুন বাংলাদেশের আবাসিক। এর মধ্যে কেবল বাংলা শকুনই বর্তমানে দেশে আছে। বাকি প্রজাতিগুলো অনিয়মিতভাবে দেখা যায়। বাংলা অঞ্চলের নামে নামাঙ্কিত বাংলা শকুনের দেশে বিলুপ্তপ্রায় হয়ে যাবার বাস্তবতাটা মর্মান্তিক।

 

বাংলাদেশে থাকা ৭ টি প্রজাতির মধ্যে বাংলা শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরু-ঠুঁটি শকুন ও রাজ শকুন বাংলাদেশের আবাসিক। এর মধ্যে কেবল বাংলা শকুনই বর্তমানে দেশে আছে। বাকি প্রজাতিগুলো অনিয়মিতভাবে দেখা যায়। বাংলা অঞ্চলের নামে নামাঙ্কিত বাংলা শকুনের দেশে বিলুপ্তপ্রায় হয়ে যাবার বাস্তবতাটা মর্মান্তিক।

 

২০০৬ সালে শুরু হওয়া শকুন সংরক্ষণ আন্দোলনের ফল হিসেবে বাংলাদেশ ২০১০ সালে গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। কিন্তু এটি নিষিদ্ধ করার পরে বাজারে আসে কিটোপ্রোফেন, এসিক্লোফেনাক, ফ্লুনিক্সিনি নামের আরও কিছু ওষুধ, যার সবকটিই সমান ক্ষতিকর। বাংলাদেশ ২০২১ সালে পশুর চিকিৎসায় কিটোপ্রোফেনও নিষিদ্ধ করে। এরপরে ব্যবহার বাড়ানো হয় মেলোক্সিক্যাম ও টালফামেনিক এসিডের যা শকুনের জন্য নিরাপদ।

 

বাংলাদেশের হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা ও সুন্দরবনে শকুনদের জন্য তৈরি করা হয়েছে ফিডিং স্টেশন। সেখানে নিয়মিত শকুনদের জন্য গবাদি পশুর জোগান দেওয়া হয়। নেওয়া হয়েছে ১০ বছর মেয়াদি (২০১৬-২০২৫) কর্মপরিকল্পনা। এছাড়াও বন অধিদপ্তর ও আইইউসিএন এর উদ্যোগে খুলনা, বরিশাল ও সিলেট অঞ্চলে শকুনদের জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘নিরাপদ এলাকা’, যেখানে শকুনদের খাবার সরবরাহ,প্রজনন, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার কাজ করা হচ্ছে। পরিবেশবাদী সংগঠন ‘তীর’ গত তিন বছরে উত্তরাঞ্চলে মোট ১৮ টি শকুন উদ্ধার করে রেসকিউ সেন্টারেও নিজেরা অবমুক্ত করেছে। এইসব উদ্যোগে ধীরে ধীরে শকুনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

শকুনকে বিপন্ন হওয়া থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব কেবল সরকার বা পরিবেশসংক্রান্ত সংস্থাগুলোর নয়, তা সম্ভবও নয়। গবাদি পশুর চিকিৎসায় ক্ষতিকর ওষুধের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা জরুরি। শকুনদের খাদ্যচাহিদা পূরণের সাথে সাথে তাদের আবাসস্থল নিশ্চিতের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট কিছু গাছ লাগানো প্রয়োজন। যাঁরা কৃষিকাজে জড়িত, তাঁদের থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকদেরও এই বিষয়ে সচেতন করতে হবে।

 

কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন শকুন নামের পাখিটি সম্পর্কে সকল নেতিবাচক ধারণা ঝেড়ে ফেলা। প্রকৃতিকে সাফসুতোর রাখে যে পাখিটি, তাকে রক্ষা করতে হবে আমাদের সকলের স্বার্থেই।

 

 

জয়ন্তী রায়না

লেখক ও আলোকচিত্রী

Your Comment