শুক্রবার ৬ই বৈশাখ ১৪৩১ Friday 19th April 2024

শুক্রবার ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

Friday 19th April 2024

আন্তর্জাতিক জলবায়ু

ক্যান্সার গলি: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ জনপদে বিষাক্ততার সম্প্রসারণ

২০২২-০৫-০৯

গ্রিনপিস এর প্রতিবেদনের সারসংক্ষিপ্ত অনুবাদ
তর্জমা : ইরফানুর রহমান রাফিন

মিসিসিপি নদীর পাশে স্তুপ করে রাখা এক্সনের রিফাইনারির তেলের ড্রাম। এগুলো থেকে নিঃসরিত খনিজ তেল ভয়াবহ দূষণ সৃষ্টি করছে। ছবি উইকিপিডিয়া।

 

"আমরা আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছি, কারণ এটা সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ" -শ্যারন লেভিন, প্রতিষ্ঠাতা, রাইজ সেইন্ট জেমস 

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের একটি বিশেষ অঞ্চল ‘ক্যান্সার গলি’ নামে পরিচিত। ১৯৮০-র দশকে অঞ্চলটি এই নাম লাভ করে। নিকটবর্তী রাসায়নিক কারখানাগুলো থেকে সৃষ্ট বিষাক্ত দূষণের কারণে যে-ক্যান্সার বলয় তৈরি হয়েছিল বলে স্থানীয়রা সন্দেহ করেন, তা থেকেই এই নামের উৎপত্তি।

 

অঞ্চলটিতে বর্তমানে প্রায় ১৫০টি তেল শোধনাগার এবং প্লাস্টিক ও রাসায়নিক কারখানা আছে। উল্লেখ্য যে, এই অঞ্চলটিতে জনঘনত্ব আফ্রিকান/কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের সংখ্যা জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি। জাতিসংঘের মতে, এখানে দূষণকারী শিল্পগুলোকে ঘনীভূত করার কারণে আফ্রিকান আমেরিকানদের মানবাধিকার তীব্র হুমকির মুখে পড়েছে।

 

এক গবেষণায় জানা গেছে, যে-জনমিতি অঞ্চল বিষাক্ত বায়ু দূষণের সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে আছে, তা দুটি প্যারিস (গ্রামীণ প্রশাসনিক অঞ্চল) নিয়ে গঠিত। এই এলাকা দুটি হচ্ছে ইস্ট ব্যাটন রুজ প্যারিশ আর নিউ অরলিয়েন্স প্যারিশ। এই অঞ্চল দুটিতে আফ্রিকান আমেরিকানদের জনসংখ্যার হার যথাক্রমে ৮৪ শতাংশ ও ৬০ শতাংশ।

 

“দূষণকারী শিল্পগুলো ঘুরেফিরে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর কাছেই আসে, কারণ তারা জানে, (দূষণের কারণে এই জনগোষ্ঠীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে) কেউ কিছু বলবে না।”

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশগত সংরক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান দি এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিএ)-র  ২০১৫ সালের পরিচালিত বায়ুতে দূষিত উপাদানের মানচিত্র অনুসারে দেশটিতে বায়ু দূষণজনিত কারণে ক্যান্সারের সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকা ১০টি লোকবসতির ৭টিই সেইন্ট জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট প্যারিশে অবস্থিত। যে-১১টি প্যারিশ মিলে ক্যান্সার গলি গঠন করেছে, এটি তাদের একটি। পরিবেশগত ন্যায়বিচারকামী সংগঠন রাইজ সেই ন্ট জেমসের প্রতিষ্ঠাতা শ্যারন লেভিনের ভাষায়, “দূষণকারী শিল্পগুলো ঘুরেফিরে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর কাছেই আসে, কারণ তারা জানে, (দূষণের কারণে এই জনগোষ্ঠীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে) কেউ কিছু বলবে না।”

 

তাইওয়ানি কোম্পানি ফরমোজা প্লাস্টিকস সেইন্ট জেমস প্যারিশে একটা বিশাল প্লাস্টিক উৎপাদন কমপ্লেক্স তৈরি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি স্বীকার করেছে, এই প্রকল্পের চালিকাশক্তি হল গ্যাসের দাম কমে যাওয়া ও প্লাস্টিকের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া। এছাড়াও, তাইওয়ানে বায়ু ও পানি দূষণের প্রতিবাদের মুখে উৎপাদনের পুরো ব্যবস্থাটা অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তাইওয়ানের যে-আকাঙ্খার কথা খবরে এসেছে, এই প্রকল্প তার সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ। কমপ্লেক্স তৈরির বিরোধীদের মতে, কমপ্লেক্সটি একবার-ব্যবহার্য প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের কাজে ব্যবহারের জন্য রেজিন ও পেট্রোকেমিক্যাল উৎপাদন করবে। এই কমপ্লেক্স একটি আফ্রিকান আমেরিকান অধ্যুষিত জন বসতি ও প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাত্র এক মাইল দূরত্বে স্থাপন করা হবে । তারপরও লুজিয়ানা ডিপার্টমেন্ট অফ এনভায়রনমেন্টাল কোয়ালিটি (এলডিইকিউ) ফরমোজা প্লাস্টিকসকে একাধিক ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কার্সিনোজেন ও অন্যান্য ক্ষতিকর দূষণকণা নিঃসরণের অনুমতি দিয়েছে।

 

কমপ্লেক্স তৈরির বিরুদ্ধে যারা প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন তাদের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) যে-সাম্প্রতিকতম বিজ্ঞানসম্মত মান অনুসারে পরিচালিত হয়, এ-ক্ষেত্রে তা উপেক্ষা করা হয়েছে।

 

ইপিএ ডাটা থেকে আরো দেখা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত, ব্যাটন রুজে নির্মিত ফরমোজা প্লাস্টিকসের আরেকটি কেন্দ্র বারবার ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট লঙ্ঘণ করে এসেছে।

 

বিষাক্ত দূষণের কথা একপাশে সরিয়ে রাখা যাক।

 

ফরমোজার প্লাস্টিক কারখানার তীব্র দূষণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাচ্ছেন একজন অধিবাসী

 

নতুন কমপ্লেক্সটি ২০২৯ সালের মধ্যে পুরোপুরি কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে, তবে নির্মাণকাজের প্রথম ধাপ ২০২৪ সালের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যাবে। এই কমপ্লেক্সকে বছরে ১৩.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এটা একই সময়ে ২.৬ মিলিয়ন গাড়ি যে-পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে তার সমান।

 

ফরমোজা প্লাস্টিকসের পক্ষের আইনজীবীরা এই কমপ্লেক্স নির্মাণের পক্ষে একটা অদ্ভূত যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের যুক্তিটা হল, যেহেতু এই কমপ্লেক্সের নিঃসরণ জাতীয় ও বৈশ্বিক নিঃসরণের তুলনায় ‘সামান্য’, তাই জলবায়ু পরিবর্তনে এর সম্ভাব্য ভূমিকাকেও ‘সামান্য’ বলে বিবেচনা করতে হবে। লুজিয়ানা ডিপার্টমেন্ট অফ এনভায়রনমেন্টাল কোয়ালিটি (এলডিইকিউ) কমপ্লেক্সটিকে এয়ার কোয়ালিটি পারমিট অ্যাপ্রুভাল প্রদান করার সময়ও একই ধরণের যুক্তি প্রদর্শন করেছে: যেহেতু গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ দুনিয়ার সর্বত্রই জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তাই কমপ্লেক্সটি অন্য কোথাও নির্মিত হলেও তাতে এমন কিছু তারতম্য হত না। সে-ক্ষেত্রে লুজিয়ানাতে কমপ্লেক্স নির্মাণ করাটাই বরং ভালো। কারণ তাতে রাজ্যটি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। ২০২১ সালের এপ্রিলে নিউ অরলিয়েন্সের পৌর কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে কমপ্লেক্স নির্মাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অত্র অঞ্চলে নির্মাণ কাজ চলছে এমন ৮৮টি কেন্দ্রের একটি মাত্র ফরমোজা প্লাস্টিকসের এই কারখানা।

 

টেক্সাসের হিউস্টনে এক্সনমোবিলের বেটাউন কমপ্লেক্সে একটি অলেফিন নামের কৃত্রিম কাপড় তৈরির কারখানা আছে। এটি দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ ইথিলিন উৎপাদনকারী কারখানা। এই কারখানার বাতাসের মান লঙ্ঘণের ইতিহাস অন্তত তিন দশক পুরনো। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে টেক্সাস কমিশন অন এনভায়রেনমেন্টাল কোয়ালিটি একে ২২ বার জরিমানা করেছে। জানা গেছে, বেটাউন ফ্যাসিলিটি সৃষ্ট দূষণের জন্য অশ্বেতাঙ্গ ও গরীব জনগোষ্ঠী অনেক বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতকিছুর পরও ২০১৯ সালে এখানে একটি মাল্টি বিলিয়ন ডলারের ইথেন ক্র্যাকার নির্মাণের কাজ শেষ করা হয়েছে। এটা এক্সনমোবিলের ১০ বছর মেয়াদী ২০ বিলিয়ন ডলারের ‘গ্রোয়িং দা গালফ’ সম্প্রসারণ কর্মসূচির অংশ। নতুন ক্র্যাকারের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার মাসখানেকের মধ্যে অলেফিন কারখানার এক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে ৩৭ জন আহত হয়েছেন।

 

এক্সনমোবিল সৌদি আরামকোর সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান সাবিকের সাথে টেক্সাসের কর্পাস ক্রিস্টির কাছাকাছি এক জায়গায় একটি ইথিলিন ও পলিথিলিন কমপ্লেক্সের একটি অংশীদারী উদ্যোগে জড়িত। কারখানাটির জন্য যে-বিপুল পরিমাণ পানির প্রয়োজন হবে, তার জন্য সমুদ্রের পানি লবন মুক্ত করার প্লান্ট নির্মাণের জন্য ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করছে। এই কারখানা নির্মাণের বিরোধীদের মতে, এতে জলজ জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে ও নানাপ্রকার জলবায়ু ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে, কেননা শোধনকৃত লবণ সমুদ্রে নিক্ষপ করা হবে।

 

‘ক্যান্সার গলি’ নামে অভিহিত এই অঞ্চলটিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একরৈখিক ধারণার কাছে প্রাণপ্রকৃতির সুরক্ষার প্রসঙ্গটিকে যে বলি দেয়া হয়েছে তা পরিষ্কার। একইসাথে উন্নয়নের বর্ণগত ও শ্রেণিগত ব্যাকরণটিও দৃশ্যমান। আখেরে এই কথিত উন্নয়নের প্রধান ভুক্তভোগী হবেন আফ্রিকান আমেরিকান আর স্বল্প আয়ের মানুষেরা। উন্নয়নের বলি সর্বত্রই দরিদ্র, সংখ্যালঘু ও বর্ণবাদের শিকার জনগোষ্ঠী, ক্যান্সার গলির এই গল্পে সেই সত্যই আবারও প্রমাণিত হলো। যদিও এই বাস্তবতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামও চলমান।

 

 গ্রিনপিসের ক্লাইমেন্ট ইমারজেন্সি আনপ্যাকড এর সেপ্টেম্বর ২০২১ সংখ্যা অবলম্বনে।

 

Your Comment