শুক্রবার ১২ই বৈশাখ ১৪৩১ Friday 26th April 2024

শুক্রবার ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

Friday 26th April 2024

আন্তর্জাতিক দক্ষিণ এশিয়া

আমাদের চেনাজানা দুনিয়ার খানখান হয়ে যাওয়া

২০২২-১০-২৬

অরুন্ধতী রায়

[অরুন্ধতী রায়ের বক্তৃতা যা বলা যায়, আর যা বলা যায় না: আমাদের চেনাজানা দুনিয়ার খানখান হয়ে যাওয়া এর দ্বিতীয় অংশ এটি। গত ৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কনওয়ে হলে এ বক্তব্য দেন লেখক, যার প্রথম অংশ যা বলা যায়, আর যা বলা যায় না গত ১৬ অক্টোবর দৃকনিউজে প্রকাশিত হয়েছে। বক্তৃতার দ্বিতীয় পর্বে দেখা যায়, শক্তিমতী এই লেখক মনে করেন হতাশ হওয়ার জন্য আমাদের লক্ষ লক্ষ যথার্থ কারণ আছে বলেই আমাদের উচিত আশাকে যুক্তি থেকে আলাদা করে দেখা। আশাকে হতে হবে উদ্দাম, অযৌক্তিক এবং নিরর্থক। দুই পর্বের এই বক্তৃতার দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব আমাদের চেনাজানা দুনিয়ার খানখান হয়ে যাওয়া প্রকাশিত হলো আজ।] 

 

প্রথম পর্ব: যা বলা যায়, আর যা বলা যায় না

 

যারা আমাদের পীড়ন করে তাদের কেন আমরা ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি? এটাই হতে পারে আমাদের সময়ের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রশ্ন

 

 

এখন আমি আমার বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশে যাবো- তা হলো আমাদের চেনাজানা দুনিয়ার খানখান হয়ে ভেঙে পড়া। আমি রাণী ও তাঁর শেষকৃত্য নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।’

 

রাণীর মৃত্যুর পর কয়েকটি ব্রিটিশ খবরের কাগজ রাণীকে নিয়ে লিখতে অনুরোধ করে আমাকে। অনুরোধটা শুনে আমি একটু হতচকিত হয়ে গেছিলাম। কোনোদিন ইংল্যান্ডে বাস করিনি বলেই সম্ভবত রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এমনকি আমার কল্পনার সীমারেখাতেও তেমন একটা আসেননি। কাজেই আমি বললাম, ঠিক আছে, কিন্তু লেখাটা আপনারা যে রাণীর কথা ভাবছেন তাঁকে নিয়ে হবে না।

 

রাণীর শেষকৃত্যের রীতি ও প্রথা পালন নিয়ে যে পরিমাণ আড়ম্বর ও সমারোহ হয়েছে এবং কয়েক দিনব্যাপী টেলিভিশনে যেভাবে তা সম্প্রচার করা হয়েছে, তা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হচ্ছিলো। বর্তমানে কমনওয়েলথ নামে পরিচিত ভূতপূর্ব উপনিবেশগুলোতে উঁচু পদে থাকা অশ্বেতাঙ্গরা যে খোশামোদ ও ভক্তির সঙ্গে শ্রদ্ধা নিবেদন করছিলো তা আমাকে অসাড় করে দিয়েছিলো। ঐ ’ওয়েলথ’ এর কোনোকিছুই ‘কমন’ ছিলো না। ঐ সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিলো, এবং তা পৌঁছেছিলো একটিমাত্র জায়গাতেই। আমরা উপনিবেশের অধিবাসীরাই ঐ পোশাক, ঐ ফার, ঐ গহনা আর ঐ সোনার রাজদণ্ডের দাম চুকিয়েছি

 

যে রাণীর কথা আমি ভাবছিলাম তিনি আমার মা– যিনি একটা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তা চালাতেন, আর যিনি এ মাসের (সেপ্টেম্বর) শুরুর দিকে মারা গেছেন। বিষয়টা ভালো নাকি মন্দ জানি না, কিন্তু তিনিই আমার জীবনে সবচেয়ে অনন্য ও সবচেয়ে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। আমরা ছিলাম পরস্পরের আদায়-কাঁচকলায় বিরোধী এবং একইসঙ্গে অসম্ভব ভালো বন্ধু। খুব কম বয়স থেকেই যে বাধা আমি পেরোতে চেয়েছিলাম, আমার মা ছিলেন সেই বাধা। এখন তিনি চলে গেছেন। এতে শুধু আমার মন ভেঙে যায়নি, আমার হৃদয় একেবারে পিষ্ট হয়ে গেছে। এখন আমার বেঢপ আকৃতি বা কাঠামো আমার কাছে আর কোনো অর্থই বহন করে না। আজকের এই বক্তব্য এই দুই শেষকৃত্যের রাজনীতি নিয়ে দিতে লোভ হয়েছিলো আমার। একটা শেষকৃত্য হয়েছে পৃথিবীর মঞ্চে আর অন্যটা দক্ষিণ ভারতের ছোট এক শহরে। কিন্তু আমি এই লোভ সংবরণ করবো।

 

প্রথম পর্ব: যা বলা যায়, আর যা বলা যায় না

 

এখন সম্ভবত প্রথম যে কথাটা বলা যায় না, অন্তত এই সময়ে লন্ডনে বলা যায় না, সেটা বলার উপযুক্ত সময়।

 

রাণীর শেষকৃত্যের রীতি ও প্রথা পালন নিয়ে যে পরিমাণ আড়ম্বর ও সমারোহ হয়েছে এবং কয়েক দিনব্যাপী টেলিভিশনে যেভাবে তা সম্প্রচার করা হয়েছে, তা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হচ্ছিলো। বর্তমানে কমনওয়েলথ নামে পরিচিত ভূতপূর্ব উপনিবেশগুলোতে উঁচু পদে থাকা অশ্বেতাঙ্গরা যে খোশামোদ ও ভক্তির সঙ্গে শ্রদ্ধা নিবেদন করছিলো তা আমাকে অসাড় করে দিয়েছিলো। ঐ ’ওয়েলথ’ এর কোনোকিছুই ‘কমন’ ছিলো না। ঐ সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিলো, এবং তা পৌঁছেছিলো একটিমাত্র জায়গাতেই। আমরা উপনিবেশের অধিবাসীরাই ঐ পোশাক, ঐ ফার, ঐ গহনা আর ঐ সোনার রাজদণ্ডের দাম চুকিয়েছি।

 

যারা আমাদের পীড়ন করে তাদের কেন আমরা ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি? এটাই হতে পারে আমাদের সময়ের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রশ্ন

 

উপনিবেশ, উপনিবেশবাদ এবং ইতিহাসের ঐ বর্বরোচিতসময়ে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন সেসব শাসককে নিয়ে বলার অনেক কিছুই আছে। স্টুয়ার্ট হলের থেকে ভালো করে কে আমাদের সেই আখ্যান বলতে পারে? কিন্তু ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ ওই অশ্বারোহী সেনারা কুচকাওয়াজ করে যাবার সময়ে একটা দেয়ালচিত্র দল চলে যাওয়ার সময়ে ওই দুর্ভিক্ষটা কি একটা কেবল দেয়ালচিত্র? ঐতিহাসিক মাইক ডেভিস বলেন যে, উনিশ শতকের শেষ ২৫ বছরে উপনিবেশিত ভারত, চীন ও ব্রাজিলে মূলত মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে ক্ষুধায় মারা গেছেন তিন থেকে ছয় কোটি মানুষ। তিনি একে বলছেন গ্রেট ভিক্টোরিয়ান হলোকাস্ট।

 

যারা আমাদের পীড়ন করে তাদের কেন আমরা ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি? এটাই হতে পারে আমাদের সময়ের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রশ্ন।

 

আমার কথাকে যদি উপনিবেশবাদের ওপর বিস্তারিত কোনো আলাপ বলে মনে হয় তাহলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমার অবস্থান সেটা নয়। আমি নিজেকে সেই সব ভারতীয় বুদ্ধিজীবীর একজন মনে করি না যারা উপনিবেশবাদের প্রতি ক্ষিপ্ত কিন্তু আমাদের নিজের সমাজের ত্রুটির বিষয়ে চুপ করে থাকেন। হিন্দু বর্ণপ্রথা অবশ্যই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য সামাজিক স্তরায়নগুলোর একটি। অনেকেই একে বলবেন এটা উপনিবেশবাদেরই এমন একটা রূপ, যা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের চেয়েও প্রাচীন এবং এখন পর্যন্ত টিকে আছে। বর্ণবাদ এখনও আধুনিক ভারতের চালিকাশক্তি। যে পরিমাণ ভারতীয় লেখক ও বুদ্ধিজীবী বর্ণপ্রথার বিষয়টিকে পুরোপুরি এড়িয়ে যান তা চোখে পড়ার মতো। একেবারে মুখের সামনে যা আছে তাকে না দেখে থাকতে নিশ্চয়ই তাঁদেরকে খুব জটিল, বিস্তারিত কোনো যোগাসন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চর্চা করতে হয়।

 

আমার বেশিরভাগ লেখালিখির বিষয়বস্তু এসবই। তাই আপাতত আমি রাণীর শেষকৃত্য নিয়ে আমার হতচকিত হওয়ার প্রসঙ্গে ফিরে যাবো। এখানে আসলে মূল ব্যাপারটা কী? আমাকে দয়া করে কেউ সাহায্য করুন, কারণ আমি বুঝতে পারছি না।

 

এটা কোনো ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের ৯৬ বছর বয়সী শাসকের মৃত্যুর বিষয়ে হতে পারে না, যে রাষ্ট্র নিজের বিভিন্ন অংশ, অর্থাৎ স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডকে পর্যন্ত একসাথে ধরে রাখতে পারছে না। এটা কি কেবলই ফিরে দেখা, স্মৃতিকাতর আমন্ত্রণ, যে সাম্রাজ্যে সূর্য কখনও ডোবে না তার প্রেতের বিজয়গাথা? নাকি এটা তারচেয়ে বেশি কিছু? এটা কি অতীত বিষয়ক, নাকি এর বিষয়বস্তু ভবিষ্যৎ?

 

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে আমাদের চেনাজানা আধুনিক দুনিয়ার চেহারা আগাপাশতলা বদলে যেতে শুরু করেছে। ঐ চাটুকারিতা কি তাহলে আসন্ন যুদ্ধের জন্য একটা সাজানো পুতুলনাচ বা মিছিমিছি অঙ্গভঙ্গি বা শত্রু আর বন্ধুদের সম্মিলিত পদযাত্রা ছিলো?

 

বারবারা টুশম্যানের দ্য গানস অব অগাস্ট এর প্রথম অধ্যায়ের কথা মনে পড়ে গেলো আমার, যেখানে বলা হয়েছে কোন কোন ঘটনার ফলে কীভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘটলো।

 

“১৯১০ সালের মে’র সকালে নয়জন রাজার ইংল্যান্ডের রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আসার দৃশ্যটি এমনই জমকালো ছিলো যে, কালো পোশাক পরা সন্ত্রস্ত জনতা মুগ্ধতায় বিহ্বল না হয়ে পারেননি। লাল, নীল, সবুজ ও বেগুনি রঙে তিনজন তিনজন করে তাঁরা প্রাসাদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন। তাঁরা পরেছেন পালকশোভিত শিরস্ত্রাণ, মাথায় সোনালি বেণী, লাল উত্তরীয়, তাঁদের রত্নখচিত উত্তরীয় সূর্যের আলোয় ঝলকাচ্ছে। তাঁদের পরে আসলেন পাঁচ উত্তরাধিকারী, তারপর আরো চল্লিশজন মহামান্য সম্রাট বা রাজা, সাতজন রাণী… একসঙ্গে তাঁরা সত্তরটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করলেন। এযাবৎকালে এক জায়গায় এতো রাজকীয় ও পদস্থ ব্যক্তিদের বৃহত্তম সমাবেশ এটা, এবং এটা এ ধরনের সর্বশেষ সমাবেশ। বিগ বেনের কাঁটায় নয়টা বাজলে শবযাত্রীরা জায়গাটা ছাড়লো, কিন্তু ইতিহাসের ঘড়িতে সময়টা তখন সূর্যাস্ত। পুরনো পৃথিবীর সূর্য এক মুমূর্ষু কিন্তু আড়ম্বরপূর্ণ পৃথিবীতে ডুবে যাচ্ছে, যে ধরনের আড়ম্বর আর কখনও দেখা যাবে না।”

 

এক জায়গায় এতো রাজকীয় ও পদস্থ ব্যক্তিদের বৃহত্তম সমাবেশ এটা, এবং এটা এ ধরনের সর্বশেষ সমাবেশ। বিগ বেনের কাঁটায় নয়টা বাজলে শবযাত্রীরা জায়গাটা ছাড়লো, কিন্তু ইতিহাসের ঘড়িতে সময়টা তখন সূর্যাস্ত। পুরনো পৃথিবীর সূর্য এক মুমূর্ষু কিন্তু আড়ম্বরপূর্ণ পৃথিবীতে ডুবে যাচ্ছে, যে ধরনের আড়ম্বর আর কখনও দেখা যাবে না।”

 

ইউক্রেনে যে মারাত্মক বাজির খেলা চলছে, তা দুই পক্ষের প্রোপাগান্ডার ডামাডোলের ফলেই কিছুটা ঝাপসা হয়ে আসছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইতিহাসের ঘড়ি সূর্যাস্তের দিকে চলতেই পারে।

 

যেসব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যুদ্ধকে দেখা হয়, সেগুলোর জন্যেও বেশ কষ্টসাধ্য যোগাসনের চর্চা থাকা দরকার, কারণ এখানেও আপনি কোন পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত কিছু দেখা ও না দেখার ব্যাপার আছে। অনেক বামপন্থীই ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার বিরুদ্ধে কথা বলে উঠতে পারছেন না। তাঁদের বিশ্বাস, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের এই ক্ষোভ পুরোপুরি পশ্চিম সাম্রাজ্যবাদের তৈরি। যেন ১৯৩০ এর দশকের শুরুর দিকে ইউক্রেনে কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। ১৯৩০ এর দশকের শুরুর দুর্ভিক্ষে স্ট্যালিনের বাধ্যতামূলক সমবায় ব্যবস্থার ফলে যে ঐতিহাসিক টিমোথি স্নাইডারের হিসাব অনুযায়ী ৫০ লক্ষ মানুষ মারা গেছেন, সেটিও তাঁরা অস্বীকার করেন।

 

তাঁরা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে দেখেন ন্যাটো কর্তৃক রাশিয়ার নিজের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ার ফলে একটি প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ হিসেবে। কথাটা মিথ্যা নয়। রাশিয়া যে একটা অত্যন্ত গুরুতর হুমকির মুখোমুখি হয়েছে তা অস্বীকার করা শক্ত। খটকাটা এখানে যে, এই “প্রতিরক্ষামূলক” যুদ্ধ আক্রমণাত্মকভাবে লড়া হচ্ছে ইউক্রেনের মাটিতে, ইউক্রেনের মানুষের বিরুদ্ধে।

 

স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বেসামরিকীকরণ ও নিরস্ত্রীকরণ শুরু হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু ন্যাটো এর ঠিক উল্টোটা করলো। সংগঠনটি আরো অস্ত্র জড়ো করলো, আরো যুদ্ধ করলো এবং নিজেদের সৈন্যদল ও ক্ষেপণাস্ত্র আরো আক্রমণাত্মক ও উস্কানিমূলকভাবে বিস্তারের জন্য মিত্রদের এলাকাও ব্যবহার করতে শুরু করলো। ন্যাটো এখন রাশিয়ার সঙ্গে যা করছে, তা যদি রাশিয়া অন্য কোন রাষ্ট্রের মাধ্যমে ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রে করতো, তাহলে এখন যেসব নীতিগত তর্ক চলছে বা পশ্চিমা গণমাধ্যম যে সমর্থন এখন দিচ্ছে তা যে সম্পূর্ণ উল্টে যেতো, সে বিষয়ে সন্দেহ সামান্যই।

 

ন্যাটো এখন রাশিয়ার সঙ্গে যা করছে, তা যদি রাশিয়া অন্য কোন রাষ্ট্রের মাধ্যমে ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রে করতো, তাহলে এখন যেসব নীতিগত তর্ক চলছে বা পশ্চিমা গণমাধ্যম যে সমর্থন এখন দিচ্ছে তা যে সম্পূর্ণ উল্টে যেতো, সে বিষয়ে সন্দেহ সামান্যই

 

কিন্তু এর কোনোটাই ভ্লাদিমির পুতিনকে বৈপ্লবিক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বা গণতন্ত্রবাদীতে পরিণত করে না। এর কোনোটাই এই সত্যকে বদলে দেয় না যে, তিনি একটি সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদী, সেমিটিকবিরোধী, সমকামী বিরোধী খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাস করেন (পরিহাসের বিষয় হলো, একে তিনি বলেন অ-নাৎসিকরণ), যার প্রবক্তা তাঁর দুই প্রিয় চিন্তক আলেক্সান্ডার দুগিন এবং আলেক্সান্ডার প্রোখানভ।

 

পুতিনের দাবি, ইউক্রেন, ক্রিমিয়া এবং বেলারুশ তিনটি অবিচ্ছেদ্য অঞ্চল, যার সমন্বয়ে প্রাচীন রুশ গঠিত হয়েছিলো। এই দাবির ভিত্তি খ্রিস্টান ব্যাপ্টিজমের ৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের নেতা ক্রিমিয়ার ভলদিমির/ ভ্লাদিমিরের সহস্র বছরের পুরনো একটি মিথ, সঙ্গত কারণেই যা হাস্যরসের খোরাক যুগিয়েছে।

 

কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসা করতেই হবে, একই মহলে যখন ফিলিস্তিনে ইসরায়েল কী করছে তা নিয়ে এবং একে ইহুদিদের প্রতিশ্রুত ভূমি হিসেবে দাবি করা নিয়ে, অর্থাৎ আধুনিক প্রেক্ষাপটে একে “ইহুদি জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র” দাবি করা নিয়ে কথা ওঠে, তখন একে হাস্যকর কেন মনে হয় না।

 

কিংবা ভারতে যখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) একইসাথে ‘অখণ্ড ভারত’ এর দাবি তোলে। আরএসএস একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী মিলিশিয়া বাহিনী, প্রধানমন্ত্রী মোদি যার একজন সদস্য। আরএসএসের এই দাবি একইসঙ্গে ভবিষ্যত ও অতীতের বিষয়ে একটি সুখকল্পনা। এখানে আদতে ভবিষ্যতের প্রাচীন এক ভারতের কথা ভাবা হচ্ছে, যেখানে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত। এই দুই দেশকে জয় করা হবে এবং দেশ দুটির সব মানুষ হিন্দু শাসনের আওতায় আসবে

 

কিংবা ভারতে যখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) একইসাথে ‘অখণ্ড ভারত’ এর দাবি তোলে। আরএসএস একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী মিলিশিয়া বাহিনী, প্রধানমন্ত্রী মোদি যার একজন সদস্য। আরএসএসের এই দাবি একইসঙ্গে ভবিষ্যত ও অতীতের বিষয়ে একটি সুখকল্পনা। এখানে আদতে ভবিষ্যতের প্রাচীন এক ভারতের কথা ভাবা হচ্ছে, যেখানে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত। এই দুই দেশকে জয় করা হবে এবং দেশ দুটির সব মানুষ হিন্দু শাসনের আওতায় আসবে। 

 

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার জবাবে রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার ফলে ইউরোপের সাধারণ মানুষ অতি সামান্য হিটিং ব্যবস্থা নিয়ে খুব কাছে এসে পড়া তীব্র শীতকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউক্রেনিয়রা অবিচল সাহসের সঙ্গে লড়ে যাওয়ার ফলে সমঝোতার মাধ্যমে মীমাংসার সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে এবং আরো বড় পরিসরে যুদ্ধ তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। পুতিন তিন লক্ষ সংরক্ষিত সেনার ‘আংশিক সংযোজন’ ঘোষণা করেছেন, যার অর্থ অনেকটা অস্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত এখনও অনেক দূরে এবং যথেষ্ট নিরাপদ, কিন্তু পুরো ইউরোপ, রাশিয়া এবং এশিয়ার অনেকখানি অংশ এমন এক যুদ্ধের রঙ্গমঞ্চ হতে চলেছে, যে ধরনের যুদ্ধ পৃথিবী আগে কখনও দেখেনি। এমন এক যুদ্ধ, যেখানে কেউ জয়ী হতে পারে না।

 

এখনই কি সবার পিছু হটার সময় নয়? এখনই কি আলোচনা শুরু করার এবং সম্পূর্ণভাবে পারবানবিক নিরস্ত্রীকরণের সময় নয়?

 

ঈশ্বর না করুন, রাশিয়া পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি ব্যবহার করছে। ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘যদি পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করা না হতো’ নামের এক নিবন্ধে পদার্থবিদ ও এমআইটির সাবেক সভাপতি কার্ল কে কম্পটন দাবি করেন, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামলা “আমেরিকা ও জাপানে শত সহস্র জীবন বাঁচিয়েছে। এটা না ঘটলে যুদ্ধ আরো অনেক মাস ধরে চলতো।” তাঁর যুক্তি হলো, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে শত শত হাজার মানুষ মারা না গেলে জাপানিরা পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও আত্মসমর্পণ করতো না এবং তাদের সর্বশেষ মানুষটি মারা না যাওয়া পর্যন্ত তারা লড়াই চালিয়ে যেতো।

 

কম্পটন নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, “পারমাণবিক বোমা কি অমানবিক ছিলো?” নিজেকেই আশ্বস্ত করে তিনি উত্তর দেন, “সব যুদ্ধই অমানবিক।” নিবন্ধটি দ্য আটলান্টিক এ প্রকাশিত হয়েছিলো। রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান এই বক্তব্যের সপক্ষে লেখেন।

 

বহু বছর পরে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে জেনারেল উইলিয়াম ওয়েস্টমোরল্যান্ড এই যুক্তিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে বলেন: “পশ্চিমাদের মতো প্রাচ্যের মানুষেরা জীবনকে এমন মূল্যবান মনে করে না। জীবন সেখানে অঢেল। প্রাচ্যে তাই জীবন সস্তা।” অন্য কথায়, আমাদের এশিয়ানদের কাছে আমাদের নিজেদের জীবনের দাম নেই, তাই আমরা শ্বেতাঙ্গ দুনিয়ার ওপর গণহত্যার বোঝা চাপিয়ে দেই

 

বহু বছর পরে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে জেনারেল উইলিয়াম ওয়েস্টমোরল্যান্ড এই যুক্তিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে বলেন: “পশ্চিমাদের মতো প্রাচ্যের মানুষেরা জীবনকে এমন মূল্যবান মনে করে না। জীবন সেখানে অঢেল। প্রাচ্যে তাই জীবন সস্তা।” অন্য কথায়, আমাদের এশিয়ানদের কাছে আমাদের নিজেদের জীবনের দাম নেই, তাই আমরা শ্বেতাঙ্গ দুনিয়ার ওপর গণহত্যার বোঝা চাপিয়ে দেই। 

 

এরপর আসি রবার্ট ম্যাকনামারার কথায়, যাঁর ক্যারিয়ার নিঃসন্দেহে সফল। প্রথমে তিনি ছিলেন ১৯৪৬ সালে টোকিয়োতে বোমা হামলার পরিকল্পনাকারী, দুই দফায় যা দুই লক্ষেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে। এরপর তিনি ছিলেন ফোর্ড মোটর কোম্পানির সভাপতি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, যিনি সৈন্যদের আদেশ দিয়েছিলেন “যা নড়াচড়া করে তাকেই হত্যা করতে”। এর ফলে তিন লক্ষ ভিয়েতনামী জীবন হারান।

 

ম্যাকনামারার শেষ কাজ ছিলো বিশ্ব ব্যাঙ্কের সভাপতি হিসেবে বিশ্বের দারিদ্র্যের দিকে নজর দেওয়া। জীবনের গোধূলি লগ্নে এরল মরিসের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র দ্য ফগ অব ওয়ার এ তিনি একটি ক্ষুব্ধ প্রশ্ন করেন- “ভালো কিছু করার জন্য আমরা কতো বেশি অনিষ্ট করতে বাধ্য হই?”

 

আপনারা নিশ্চয়ই এর মধ্যে বুঝে গেছেন যে, আমি এসব মণিমুক্তার একজন সংগ্রাহক। ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্রপতি ওবামার একটা খুনের তালিকা ছিলো। এছাড়া আছেন ম্যাডেলিন অ্যালব্রাইট, সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন যাঁর সম্বন্ধে বলেছেন “সচ্চরিত্র, মাধুর্য, শিষ্টাচার ও স্বাধীনতার প্রতিমূর্তি”। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে প্রায় ৫ লক্ষ ইরাকি শিশুর মৃত্যু সম্বন্ধে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন তা বিখ্যাত হয়ে আছে। তিনি বলেন, “এটা বেছে নেওয়া কঠিন। কিন্তু এর জন্য যে মূল্য দিতে হয়েছে, আমরা মনে করি সেই মূল্যটা যথাযথ।”

 

আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? ইউক্রেন যুদ্ধের খবর পশ্চিমা গণমাধ্যম তৎপরতার সাথে সম্প্রচার করছে। এই একই গণমাধ্যম ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর আক্রমণের ফলে শত শত হাজার মানুষ মরে যাওয়ার ঘটনা সম্প্রচার করেছে অন্যভাবে, শ্বাসরুদ্ধকর প্রশংসার সাথে

 

আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? ইউক্রেন যুদ্ধের খবর পশ্চিমা গণমাধ্যম তৎপরতার সাথে সম্প্রচার করছে। এই একই গণমাধ্যম ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর আক্রমণের ফলে শত শত হাজার মানুষ মরে যাওয়ার ঘটনা সম্প্রচার করেছে অন্যভাবে, শ্বাসরুদ্ধকর প্রশংসার সাথে। আমরা যারা ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বিপক্ষে গিয়ে সরাসরি ইউক্রেনিয় মানুষদের সঙ্গে আছি, তারাও এই দুটি ঘটনা দুই রকমভাবে সম্প্রচার করার বিষয়ে বিস্মিত না হয়ে পারছি না। ইরাকে গণহত্যার অস্ত্রশস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও তা আছে বলে গুজব রটানো হয়েছিলো ইরাক আক্রমণোকে বৈধতা দিতে। এই রটনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উৎসাহী ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ জুনিয়রের সবচেয়ে উদ্যমী মিত্র ছিলেন টনি ব্লেয়ার। এ বছর জানুয়ারিতে তাঁকে বীরত্বের সর্বোচ্চ ব্রিটিশ খেতাব নাইট কোম্প্যানিয়ন অব দ্য মোস্ট নোবল অর্ডার অব দ্য গার্টার দেওয়া হয়েছে।

 

সেদিন রাণীর শেষকৃত্য দেখতে দেখতে আমি যখন শুনলাম একজন বিশপ অথবা আর্চবিশপ বলছেন যে, যাঁরা কেবল অর্থ ও ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকে, তাদের বিপরীতে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ জনগণের জন্য তাঁর “কর্মময় জীবনের” কারণে শ্রদ্ধাভাজন ও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন- তখন আমি প্রায় বিষম খাচ্ছিলাম। তাঁর ছেলে, অর্থাৎ ইংল্যান্ডের নতুন রাজা উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর সম্পদ ও পদ পাবেন। তাঁর রাজকীয় জীবনধারার খরচ, যা কিনা প্রায় একশো কোটি টাকা, তা তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে আসবে না। এই খরচ আসবে সাধারণ ব্রিটিশ জনতার টাকা থেকে, দ্য গার্ডিয়ান এর মতে যাদের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ “আলো জ্বালাতে গিয়ে” দিনে এক বেলা না খেয়ে কাটাতে শুরু করেছেন।

 

নিজেদের রাজতন্ত্রের প্রতি ব্রিটিশ জনতার ভালোবাসা এবং মুগ্ধতার রহস্য সম্ভবত আমাদের পক্ষে বোঝা কঠিন। সম্ভবত এর সঙ্গে যুক্ত পরিচয় ও গৌরবের একটা জাতিগত চেতনা, যে চেতনাকে স্থুল অর্থনীতির সংকীর্ণতার স্তরে নামিয়ে আনা ঠিক না, আনা যায়ও না। কিন্তু দুই-এক মিনিটের জন্য আমি এই কদর্যতায় নামতে চাই।

 

দ্য ফিন্যানশিয়াল টাইমস এর সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে আয়ের অসমতা এতো বেশি যে, একে বলা যায় “এমন এক দরিদ্র সমাজ যেখানে কিছু অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি আছে”। এসব দেশ এখন আমাদের তৃতীয় বিশ্বের মতোই ব্যানানা রিপাবলিকে পরিণত হয়েছে, যার ধনীরা মহকাশে যাচ্ছে আর গরিবরা সমুদ্রে ডুবছে

 

দ্য ফিন্যানশিয়াল টাইমস এর সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে আয়ের অসমতা এতো বেশি যে, একে বলা যায় “এমন এক দরিদ্র সমাজ যেখানে কিছু অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি আছে”। এসব দেশ এখন আমাদের তৃতীয় বিশ্বের মতোই ব্যানানা রিপাবলিকে পরিণত হয়েছে, যার ধনীরা মহকাশে যাচ্ছে আর গরিবরা সমুদ্রে ডুবছে।

 

অক্সফামের ২০২২ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ভারতের শীর্ষ ৯৮ ধনীর মোট সম্পদের পরিমাণ দরিদ্রতম ৫৫২০ লক্ষ মানুষের মোট সম্পদের সমান। এই ধৃষ্টতা দেখানোর কারণে ভারতের অক্সফাম কার্যালয়গুলোতে আয়কর বিভাগ তল্লাশি চালিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ মোদি সরকারের সমালোচনা করা অন্য সব সংস্থার মতো ভারতে অক্সফামের কার্যক্রমও সম্ভবত দ্রুতই বন্ধ হয়ে যাবে।

 

রাজা তৃতীয় চার্লস ধনী হওয়া সত্ত্বেও তিনি পৃথিবীর তৃতীয় শীর্ষ ধনী গৌতম আদানির তুলনায় নিঃস্ব। গৌতম আদানি একজন কর্পোরেট পুঁজিপতি, যাঁর সম্পদের পরিমাণ ১৩৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। অতিমারীর সময়ে এই সম্পদের পরিমাণ অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

২০১৪ সালে প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর মোদি নিজের শহর গুজরাটের আহমেদাবাদ শহর থেকে দিল্লিতে আসেন আদানির ব্যক্তিগত জেট বিমানে করে। তাঁর নাম ও লোগো সেখানে খোদাই করা ছিলো। মোদির শাসনের আট বছরে আদানির সম্পদের অর্থমূল্য পৌঁছেছে ১২৯০০ কোটি মার্কিন ডলারে, যা ২০১৪ সালে ছিলো ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার। আমি শুধু বলছি, এর থেকে অন্য কিছু ভেবে বসবেন না যেন। আদানির অর্থের উৎস হলো কয়লার খনি এবং সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর পরিচালনা। অতি সম্প্রতি তিনি আগ্রাসীভাবে এনডিটিভি দখল করেছেন। এনডিটিভি ছিলো মূলধারার একমাত্র জাতীয় টেলিভিশন সংবাদমাধ্যম যা সূক্ষ্ণভাবে মোদি সরকারের সমালোচনা করতো। অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের বেশিরভাগই এর মধ্যেই কেনা হয়ে গেছে এবং তাদের অর্থ যোগানো হচ্ছে।

 

আদানির অর্থের উৎস হলো কয়লার খনি এবং সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর পরিচালনা। অতি সম্প্রতি তিনি আগ্রাসীভাবে এনডিটিভি দখল করেছেন। এনডিটিভি ছিলো মূলধারার একমাত্র জাতীয় টেলিভিশন সংবাদমাধ্যম যা সূক্ষ্ণভাবে মোদি সরকারের সমালোচনা করতো। অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের বেশিরভাগই এর মধ্যেই কেনা হয়ে গেছে এবং তাদের অর্থ যোগানো হচ্ছে

 

যেসব কর্পোরেশন পর্বতমালা ধ্বংস করছে, বনভূমিগুলোকে বিরান প্রান্তরে পরিণত করছে আর রাসায়নিক দিয়ে প্রবালপ্রাচীরের সর্বনাশ করছে, তারাই আবার ‘আনন্দ সম্মেলন’, খেলা, চলচ্চিত্র ও সাহিত্য সম্মেলন ইত্যাদির আয়োজন করে। তারাই সাহসী লেখকদের জন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেয় বাকস্বাধীনতার ওপর আঘাতের প্রশ্নে কথা বলতে এবং শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের পক্ষে প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করতে। তারাই ঠিক করে দেয় কী বলা যাবে না, আর কী করা যাবে না।

 

পুঁজিবাদ এর অন্তিম সময়ে এসে পৌঁছেছে। দুঃখের বিষয় হলো, এটা সঙ্গে করে আমাদের গ্রহটাকেও নিয়ে যাবে।

 

পারমানবিক আততায়ী এবং খনি মালিকদের মাঝখান দিয়ে এটা একেবারে পাতালে পৌঁছাবার দৌড়।

 

এর মধ্যে হালকা বিনোদনের জন্য চলুন, কোন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবো, কোন পতাকা ওড়াবো, কোন গান গাইবো তা নিয়ে কোন্দল করি। আমি যদি আপনাদের বিমর্ষ করে দিয়ে থাকি, তাহলে বরং আপনাদের একটা ইমেইল পড়ে শোনাই। ইমেইলটা আমি লিখেছিলাম দর্শকদের একজনের কথার জবাবে, গৌরী লঙ্কেশের স্মৃতিতে বক্তব্য দেওয়ার সময়ে অতিরিক্ত আশাবাদী হয়ে ওঠার জন্য যিনি আমার হালকা সমালোচনা করেছিলেন:

 

আমাদের যদি কোনো আশা না-ই থাকে, তবে চলুন আমরা সবাই বসে পড়ি এবং হাল ছেড়ে দেই। হতাশ হওয়ার জন্য আমাদের আরো লক্ষ লক্ষ যথার্থ কারণ আছে। সেজন্যই আমার মনে হয় আমাদের উচিত আশাকে যুক্তি থেকে আলাদা করে দেখা। আশাকে হতে হবে উদ্দাম, অযৌক্তিক এবং নিরর্থক।

 

আমাদের যদি কোনো আশা না-ই থাকে, তবে চলুন আমরা সবাই বসে পড়ি এবং হাল ছেড়ে দেই। হতাশ হওয়ার জন্য আমাদের আরো লক্ষ লক্ষ যথার্থ কারণ আছে। সেজন্যই আমার মনে হয় আমাদের উচিত আশাকে যুক্তি থেকে আলাদা করে দেখা। আশাকে হতে হবে উদ্দাম, অযৌক্তিক এবং নিরর্থক

 

আমার লেখা প্রতিটি বাক্যে, আমার বলা প্রতিটি শব্দে আমি সত্যিকার অর্থে যা বলছি তা হলো, আমরা ‘নেই’ হয়ে যাইনি। তোমরা আমাদের পরাজিত করতে পারোনি।

 

দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য আশা ও হতাশা নিয়ে এই বিতর্ক নিছক বিলাসিতা। এমনকি লন্ডন শহরে বিত্তের এই হাওয়ার মধ্যেও একজন পর্যটক এক ধরনের আতঙ্ক আর অস্বস্তির স্পন্দন অনুভব করতে পারেন, যেমন প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আসার আগে আগে পায়ের নিচে কম্পন টের পাওয়া যায়।

 

এসবের কোনোকিছুতেই কোনোকিছু আসবে যাবে না যদি একটা পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয়। সহজ কথায় তাতে আমরা শেষ হয়ে যাবো। দুই পক্ষেরই সরে আসার সময় এখন, এখন বাকি পৃথিবীর এগিয়ে আসার সময়। কিয়ামত/মহাপ্রলয় ঘটে গেলে দ্বিতীয় কোন সুযোগের প্রশ্ন আর থাকবে না।

 

প্রথম পর্ব: যা বলা যায়, আর যা বলা যায় না

 

 

অরুন্ধতী রায়: ঔপন্যাসিক এবং ভারতের একজন প্রধান বুদ্ধিজীবী

ভাষান্তর: দীপান্বিতা কিংশুক ঋতি

Your Comment