বৃহঃস্পতিবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০ Thursday 28th March 2024

বৃহঃস্পতিবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

Thursday 28th March 2024

আন্তর্জাতিক জলবায়ু

নিয়োনিকোটিনয়েড বিষ: ইউরোপে নিষিদ্ধ, এশিয়াতে বিস্তৃতি

২০২২-০৯-০২

মাহীন হক

গোটা পৃথিবীর জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য অনেকাংশে মৌমাছিদের উপর নির্ভর করে। অথচ কয়েক দশক ধরে পৃথিবীতে মৌমাছিরা ক্রমবিলুপ্তির পথে। গবেষণায় প্রমাণিত মৌমাছিদের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুহারের পেছনে নিয়োনিকোটিনয়েড নামক এক প্রকার কীটনাশক বিশেষভাবে দায়ী। পরে এর উৎপাদন বন্ধ করার বদলে, বেয়ার ইন্ডাস্ট্রির মত প্রভাবশালী কম্পানিগুলো গবেষকদের উপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ শুরু করে। যাতে তাদের ব্যবসা অব্যাহত থাকে। গোটা জীবজগৎ বিপন্ন করে তোলার মূল্যে হলেও বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের আর্থিক স্বার্থে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি না,  নিয়োনিকোটিনয়েড বিষ বাণিজ্য নজির এই ঘটনা।

 

জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ব্রাইসগাউ একটি ভীষণ উর্বর অঞ্চল। এখানে  ক্যানোলা ও ভুট্টার চাষ করা হয়। এই অঞ্চলেই একটি মৌমাছির খামার চালাতেন ক্রিস্টোফ কখ্। কীটনাশক নিয়ে এর আগে কোনো সমস্যায় পড়েননি তিনি। কিন্তু ২০০৮ সালের দিকে রাইন উপত্যকায় একপ্রকার নতুন কীটের আবির্ভাব ঘটে। গোটা অঞ্চলের ভুট্টার উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ে যায়। ফসল রক্ষার্থে তখন সরকার বৃহৎ পরিসরে নিয়োনিকোটিনয়েড নামক একটি কীটনাশক ব্যবহার করার অনুমতি দেয়।

 

লক্ষ্য করেন কৃষকেরা তাদের ভুট্টা রোপণ করার কিছুক্ষণ পরেই আস্তে আস্তে মৌমাছিরা ওড়া বন্ধ করে দেয় । আবহাওয়া, পরিপার্শ্ব সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু ভুট্টার বীজগুলোতে যেই কীটনাশক মাখানো ছিল তা বাতাসে ছড়িয়ে একটা ধূলিমেঘ তৈরি করে। যার ফলে সেই অঞ্চলের ১২,০০০টিরও বেশি মৌমাছির বসতি খালি হয়ে যায়। ৫০ কোটিরও বেশি মৌমাছি ধুকতে ধুকতে মারা যায়। মৌমাছি সংরক্ষণের নীতি পাশ হওয়ার পর থেকে বৈধ অনুমোদনে অনুমোদনে মৌমাছি নিধনের ঘটনা এটিই প্রথম। কিন্তু, কেন হলো এমন?

 

 

মৌমাছিদের জন্য প্রাণঘাতী কীটনাশক, নিয়োনিকোটিনয়েড। ছবি: Greenpeace Media

 

 

নিয়োনিকোটিনয়েড কী?

নিয়োনিকোটিনয়েড এক ধরনের কৃত্রিম রাসায়নিক কীটনাশক। যা গঠন ও ক্রিয়ার দিক থেকে নিকোটিনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। শস্য ও বিভিন্ন ঘরোয়া গাছে এবং পোষা পশু-প্রাণীর গায়ে জন্মানো পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এই কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে সাত প্রকারের নিয়োনিকোটিনয়েড বাজারে প্রচলিত আছে। তার মধ্যে ছয়টি (আইমিডাক্লোপোরিড, ক্লোথিয়ানিডিন, থিয়ামেথোক্সাম, ডাইনোটেফুরান, আকেটামিপ্রিড এবং থিয়াক্লোপ্রিড) ব্যবহৃত হয় শস্যের উপরে। সপ্তম একটি নিয়োনিকোটিনয়েড, নিটেনপিরাম, মূলত ব্যবহৃত হয় ঘরে পোষা প্রাণী অথবা গবাদিপশুর ক্ষেত্রে। 

 

বর্তমানে গোটা বিশ্বে সর্বাধিক ব্যবহৃত কীটনাশক হলো নিয়োনিকোটিনয়েড। বর্তমান কৃষি-রাসায়নিক বাজারের প্রায় ২৫%ই এদের দখলে, এবং এর বার্ষিক কাটতি প্রায় ১.৯ বিলিয়ন ডলার।

 

নিয়োনিকোটিনয়েডের চাহিদা এমন ব্যাপক হারে বাড়ার অন্যতম একটি কারণ হলো পুরনো কীটনাশকগুলোর তুলনায় এটি স্তন্যপায়ী ও পাখি জাতীয় প্রাণীদের জন্য কম ক্ষতিকর এই দিকটির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। নিয়োনিকোটিনয়েড মূলত পোকামাকড়ের স্নায়ুতন্ত্রকে বিকল করে ফেলার মাধ্যমে অবশ করে ফেলে| এতে অন্যান্য বড় প্রাণীদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। এছাড়াও বিভিন্ন সুবিধাজনক উপায়ে এই কীটনাশকটি ব্যবহার করা যায়। সেটিও এর ক্রমবর্ধমান চাহিদার একটি কারণ। নিয়োনিকোটিনয়েডের এই কীটপতঙ্গ বিনাশী বৈশিষ্ট্যের জন্যই শেষপর্যন্ত এটি কল্পনাতীত রকমের প্রকৃতি বিধ্বংসী একটি রাসয়নিক হিসেবে আবির্ভূত হয়।

 

 

নিয়োনিকোটিনয়েডের প্রয়োগ ও প্রভাব

নিয়োনিকোটিনয়েড একপ্রকার পদ্ধতিগত কীটনাশক। একে শস্য বা গাছের বীজে প্রলেপ হিসেবে মাখিয়ে নেয়া যায়, উপর থেকে ছিটিয়ে দেয়া যায়। এমনকি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে বীজের ভেতরেও প্রবেশ করিয়ে দেয়া যায়। পরবর্তীতে উদ্ভিদেরা এই রাসায়নিক উপাদানগুলো শিকড় ও পাতার মাধ্যমে শুষে নেয় এবং সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে তা বৃন্ত, পাতা, ফুল, ফলের মধ্যেও ছড়িয়ে মিশে যায়। এতে করে উদ্ভিদের ফুলে, পাতায়, কিংবা শিকড়েও যেসব ক্ষতিকর পোকামাকড় আস্তানা গাড়ে তাদেরও নিষ্ক্রমণ করা যায়।

 

সমস্যা হলো ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের পাশাপাশি এই কীটনাশকে মৌমাছি ও নদীর কাকড়াসহ বহু উপকারী প্রাণীর প্রাণ হুমকির মুখে পড়ে। জাপানের গবেষকরা জানান মাছেদের এই কীটনাশকের ফলে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকে। উদ্ভিদের বীজে কিংবা পাতায় এই কীটনাশকের প্রলেপ মাখানো হলে কিংবা উপর দিয়ে ছিটিয়ে দেয়া হলে তা সহজেই উদ্দিষ্ট উদ্ভিদ থেকে বাতাসের কারণে আশেপাশের শাক-সবজি কিংবা বন্য ফুল ও ফলগাছেদের গায়ে ছড়িয়ে পড়ে।  তাতে মৌমাছির মত পরাগায়নে সহায়ক পোকামাকড় মধু কিংবা ফল গ্রহণ করতে এলে প্রাণের ঝুঁকিতে পড়ে যায়। আবার তা ছড়িয়ে গিয়ে অনেকসময় বাতাসে ও পানিতে মিশে দীর্ঘদিন স্থায়ী থাকে। এতে ছোট ছোট পোকামাকড় ও মাছ হুমকিতে পড়ে।  ক্রিস্টোফ কখের মৌমাছিদের বেলায় এমনটাই ঘটেছিল। নিয়োনিকোটিনয়েড একবার ব্যবহার করা হলে পর তা জমিতে বহু বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। একবার ব্যবহারের পর জমিতে সেচ দেয়া হলেও ছয় বছর পর কিছু গাছের কাণ্ডে এর অবশিষ্টাংশ খুঁজে পাওয়া গেছে। এ কীটনাশক একজায়গায় প্রয়োগ করার পর সেখানকার আশেপাশেরও অনেকখানি অঞ্চলের মাটি, পানি ও বাতাস পোকামাকড় ও মাছেদের জীবনধারণের অনুপযোগী হয়ে ওঠে।

 

 

নিয়োনিকোটিনয়েড মিশ্রিত ফুলে মধু সংগ্রহ করতে এসে মৃত্যু হচ্ছে মৌমাছির। ছবি: Gardening Know How

 

 

মানুষ ও অন্যান্য বড় স্তন্যপায়ী কিংবা মেরুদণ্ডী প্রাণীদের জন্য ঝুঁকির কারণ না হলেও, নিয়োনিকোটিনয়েড প্রয়োগের ফলে মৌমাছির মত পরিবেশের জন্য ¸গুরুত্বপূর্ণ উপকারী কীটপতঙ্গ ও প্রাণীদের অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। প্রাণীজগতের সবচেয়ে বিশাল এবং বৈচিত্রপূর্ণ শ্রেণী হলো কীট-পতঙ্গ শ্রেণী। পুরো পৃথিবীতে বর্তমানে নব্বই লক্ষেরও বেশি প্রজাতির পতঙ্গ শনাক্ত করা গেছে, এবং ধারণা করা হয় বাস্তবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এবং এই বিপুলসংখ্যক প্রাণী-সম্বলিত শ্রেণীটির ১% এরও কম প্রজাতিকে ক্ষতিকর কীট বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া পরিবেশে ভারসাম্য বজায় রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে এই শ্রেণীর প্রাণীরাই। প্রকৃতিতে পুষ্টি চক্র চালু রাখা, ক্ষতিকর কীট নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং পরাগায়নের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে তারা বিশাল অবদান রেখে থাকে। পুরো পৃথিবীর ৮৫% সপুষ্পক উদ্ভিদ এবং ৩৫% শস্য উৎপাদিত হয় এই পরাগায়নের বদৌলতে। পরাগায়নে অন্যতম প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে মৌমাছিরা। অথচ বহুবছর ধরে অসুখ-বিসুখ, পরজীবির আক্রমণ ও অন্যান্য বহু কারণে মৌমাছির বসতি গোটা বিশ্বে ক্রমশই কমে আসছে। বসতি-ধ্বস ব্যাধি (Colony Collapse Disorder, CCD) নামক একটি উপদ্রবের কারণে ইউরোপে মৌমাছিদের বসতির সংখ্যায় আচমকা ধ্বস দেখা দেয়| তারপরে আমেরিকায়ও ২০০৬-২০০৭ সালের শীতকালে একই অবস্থা দেখা দেয়।

 

 

 

কলোনি কলাপস ডিসওর্ডার (সিসিডি) এর মত মহামারির শিকার হয়ে মৌমাছিরা এমনিতেই সংকটে আছে।  ছবি: Microbewiki

 

 

এখনও প্রতিবছর শীতকালে মৌমাছিদের মৃত্যুর হার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বলে জানান মৌমাছি-চাষীরা। এর পিছে প্রধানতম একটি কারণ হলো নিয়োনিকোটিনয়েড, যা মৌমাছিদের জন্য প্রচণ্ড বিষাক্ত এবং প্রাণঘাতী একটি উপাদান। তবুও গোটা বিশ্বে এটি এখনও সবচাইতে বহুলব্যবহৃত কীটনাশক। শুধুমাত্র আমেরিকা ও কানাডাতেই প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ একর জমি জুড়ে এই কীটনাশক ব্যবহৃত হয়। ১৯৯২ হতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কেবল জার্মানিতেই ৩৭০০ টন নিয়োনিকোটিনয়েড বিক্রি হয়েছে। এরই ফলস্বরূপ, মৌমাছির সংখ্যাও পৃথিবীতে আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে।

 

গোটা জীবজগৎ যে খাদ্যশৃঙ্খলের উপর নির্ভর করে বাঁচে তার ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ করে মৌমাছির মত প্রাণীরা। একটা ছোট্ট কোকিল হতে শুরু করে মস্ত বড় ভাল্লুকেরা যে বীজ ও ফলমূল খেয়ে বাঁচে তার পিছে কৃতিত্ব ওই ছোট্ট পোকাগুলোর। তাই জীববৈচিত্র্য, কৃষি ও আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে হলেও মৌমাছির মত প্রাণীদের সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি।

 

 

ব্যবসা ও নৈতিকতা

কেন এখনও ব্যবহার করতে দেয়া হচ্ছে নিয়োনিকোটিনয়েডের মত ক্ষতিকর উপাদানগুলো? সোজা উত্তর: ব্যবসা। গোটা পৃথিবীতে নিয়োনিকোটিনয়েড জাতীয় কীটনাশকের অন্যতম প্রধান উৎপাদক হলো বেয়ার (Bayer) ইন্ডাস্ট্রি। প্রতিবছর এর মাধ্যমে তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা চাইবে তাদের এই ব্যবসা অব্যাহত থাকুক। তাতে সব মৌমাছি বিলুপ্ত হলে হোক, পরাগায়ন বিপন্ন হলে হোক। ১৯৯১ সালে বেয়ার কর্তৃক পরিচালিত একটি গবেষণাতেই ডাচ রসায়নবিদ হেঙ্ক টেনেকেস প্রথমবারের মত নিয়োনিকোটিনয়েডের ক্ষতিকর প্রভাবের প্রমাণ তুলে ধরেন। তার গবেষণার মাধ্যমে জানা যায় নিয়োনিকোটিনয়েডের প্রয়োগের ফলে বৃহদাকারে মৌমাছিদের স্নায়ুবিকার এবং মৃত্যু ঘটে থাকে। এটি পরিবেশের জন্য ভয়াবহ মাত্রায় ক্ষতিকর। সেইসাথে খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে এটি পাখি ও সরীসৃপদের প্রতিও হুমকির কারণ হতে পারে। টেনেকেস তার গবেষণার ফল প্রকাশ্যে আনতে চাইলে বেয়ার ইন্ডাস্ট্রি নানানভাবে তার উপর চাপ দেয় গবেষণা প্রকাশ না করার জন্য।  অবশেষে তারা নানারকম চাতুরির মাধ্যমে টেনেকেসের গবেষণার বক্তব্যকে ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ, নিজেদের উৎপাদিত দ্রব্যের ক্ষতির মাত্রা সম্পর্কে অবহিত থাকার পরেও বেয়ার কম্পানি সত্য লুকিয়ে সেই দ্রব্যের বিক্রি অব্যাহত রাখে।

 

 

ডাচ রসায়নবিদ হেঙ্ক টেনেকেস প্রথমবারের মত নিয়োনিকোটিনয়েডের ক্ষতিকর প্রভাবের প্রমাণ তুলে ধরেন। তার গবেষণার মাধ্যমে জানা যায় নিয়োনিকোটিনয়েডের প্রয়োগের ফলে বৃহদাকারে মৌমাছিদের স্নায়ুবিকার এবং মৃত্যু ঘটে থাকে। এটি পরিবেশের জন্য ভয়াবহ মাত্রায় ক্ষতিকর। সেইসাথে খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে এটি পাখি ও সরীসৃপদের প্রতিও হুমকির কারণ হতে পারে। টেনেকেস তার গবেষণার ফল প্রকাশ্যে আনতে চাইলে বেয়ার ইন্ডাস্ট্রি নানানভাবে তার উপর চাপ দেয় গবেষণা প্রকাশ না করার জন্য।  অবশেষে তারা নানারকম চাতুরির মাধ্যমে টেনেকেসের গবেষণার বক্তব্যকে ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ, নিজেদের উৎপাদিত দ্রব্যের ক্ষতির মাত্রা সম্পর্কে অবহিত থাকার পরেও বেয়ার কম্পানি সত্য লুকিয়ে সেই দ্রব্যের বিক্রি অব্যাহত রাখে 

 

 

এরপরে ফ্রান্সেও কৃষকেরা অস্বাভাবিক মাত্রায় মৌমাছিদের মৃত্যুর খবর জানান।  ফ্রান্স সরকারের আদেশে কৃষি মন্ত্রনালয় কর্তৃক একটি গবেষণা শুরু করা হয়। তখনও বেয়ার কম্পানি নানাভাবে জোর খাটানোর চেষ্টা করে। এমনকি এক পর্যায়ে কৃষকদের উপর মানহানির মামলা করে। যদিও তারা সেই মামলায় হারে এবং গবেষণাকার্যও আপাত স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, রসায়নবিদ জাঁ-মার্ক বোমাটোঁ জানান, গোটা গবেষণা প্রক্রিয়া জুড়ে বেয়ার কম্পানি বারবার বিভিন্ন বিষয়ে নাক গলাতে থাকে। গবেষণা, অর্থায়ন এবং এমনকি ফলাফলের প্রকাশনার ক্ষেত্রেও কম্পানি নানাভাবে নিজেদের কর্তৃত্ব খাটায়। এমন অবস্থাতেই গবেষণা চলতে থাকে। কথা ছিল একটি সূর্যমুখীর ক্ষেতের একাংশে নিয়োনিকোটিনয়েড প্রয়োগ করা হবে এবং অপর পাশে কোনো কীটনাশক দেয়া হবে না। উভয় অংশে মৌমাছির মৃত্যুর হার তুলনা করে দেখা হবে। কিন্তু পরীক্ষার পর দেখা গেল উভয় অংশেই মৌমাছির মৃত্যুর হার প্রায় সমান। অর্থাৎ প্রমাণ হয়ে গেল মৌমাছির উপর নিয়োনিকোটিনয়েডের স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক ক্ষতিকর কোনো প্রভাব নেই। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছিল তা ভিন্ন।

 

আসলে বেয়ার কম্পানির লোকেরা ক্ষেতের যে অংশে কোনো কীটনাশক প্রয়োগ করার কথা ছিল না সেই অংশেও ক্ষতিকর কীটনাশক মিশিয়ে রেখেছিল। অর্থাৎ এরকম রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের একটি গবেষণাতেও বেয়ার কম্পানি অনায়াসে জালিয়াতি করে পার পেয়ে গেল। এমনকি এই ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নালিশ জানাতে গেলে গবেষণার তদারকি কমিটি সেটাকে বিন্দুমাত্রও গ্রাহ্য করেনি। উলটো কিছুক্ষেত্রে স্বয়ং কৃষি মন্ত্রণালয় কম্পানির হয়ে তাবেদারি করতে থাকে। ফলে এবারের মতও বেয়ার কম্পানি নিজের ব্যবসা টিকিয়ে সুন্দরমত ফাঁক গলে বেরিয়ে এল।

 

 

আসলে বেয়ার কম্পানির লোকেরা ক্ষেতের যে অংশে কোনো কীটনাশক প্রয়োগ করার কথা ছিল না সেই অংশেও ক্ষতিকর কীটনাশক মিশিয়ে রেখেছিল। অর্থাৎ এরকম রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের একটি গবেষণাতেও বেয়ার কম্পানি অনায়াসে জালিয়াতি করে পার পেয়ে গেল। এমনকি এই ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নালিশ জানাতে গেলে গবেষণার তদারকি কমিটি সেটাকে বিন্দুমাত্রও গ্রাহ্য করেনি। উলটো কিছুক্ষেত্রে স্বয়ং কৃষি মন্ত্রণালয় কম্পানির হয়ে তাবেদারি করতে থাকে। ফলে এবারের মতও বেয়ার কম্পানি নিজের ব্যবসা টিকিয়ে সুন্দরমত ফাঁক গলে বেরিয়ে এল।

 

 

কিন্তু বেমাটোঁ আর তার সহকর্মীরা এরপরে বেয়ার কম্পানিকে না জানিয়ে নিজেদের মত আরেকটি গবেষণাকার্য চালান এবং এর ফলাফল যা দাঁড়ায় তা ছিল বিস্ময়কর। তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হন মৌমাছিগুলোর মৃত্যুর জন্য যাকিছু দায়ী তার সবটাই ওই নিয়োনিকোটিনয়েড-জনিত।  অবশেষে, ১৯৯৯ সালে ফ্রান্স নিয়োনিকোটিনয়েডের ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে | কিন্তু তা কেবল সূর্যমুখীর চাষের ক্ষেত্রে। মৌমাছি-চাষীরা এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। সকলপ্রকার নিয়োনিকোটিনয়েডের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি তোলেন তারা। অবশেষে ২০১৮ সালে ফ্রান্স সকলপ্রকার নিয়োনিকোটিনয়েড দ্রব্যের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

 

 

ফ্রান্স সর্বপ্রথম দেশ যে সকলপ্রকার নিয়োনিকোটিনয়েডের প্রয়োগ নিষিদ্ধ করে। ছবি: Deutsche Welles

 

 

২০০৮ সালে ব্রাইসগাউয়ের সেই ঘটনার পর জার্মানিতেও একইরকম গবেষণা শুরু করার ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু পরে জানা যায় সেই গবেষণাও আগাগোড়া পরিচালনা করছে বেয়ার কম্পানি নিজে।  ফলত, স্বাভাবিকভাবেই, সেই গবেষণার ফলাফলে জানা যায় মৌমাছির মৃত্যুর সাথে নিয়োনিকোটিনয়েডের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এরূপ মিথ্যাচার ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করতে সম্পৃক্ত বিজ্ঞানীরা সেই গবেষণা ছেড়ে সরে আসেন। 

 

এরপরে স্প্যানীয় রসায়নবিদ ফ্রাসিস্কো সাঞ্চেজ-বায়োর গবেষণামতে জানা যায় নিয়োনিকোটিনয়েড কেবল মৌমাছি না, বরং গোটা পরিবেশের উপরেই ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। তিনি দেখেন জাপানের একটি ধানক্ষেতে এই দ্রব্য প্রয়োগ করা হলে পর তার কাছের একটা নদীর প্রত্যেকটি মাছ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাকেও তার গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে দেয়া হয় না। পরে তিনি স্বতন্ত্রভাবে তা প্রকাশ করেন।

 

এই ঘটনাগুলো থেকেই বোঝা যায় কৃষিতে কীটনাশক ব্যবহারে প্রসার বৃদ্ধি করার জন্য। এসকল গবেষণার পিছনে আসল কলকাঠি নাড়ছিলেন দুনিয়ার বড় বড় কীটনাশক ব্যবসায়ীরা। কীটনাশক ব্যবসার স্বার্থে সরকারি প্রক্রিয়াগুলোকেও  তাদের গণ্য করতে হয়নি । ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়, শেষমেষ স্বয়ং বিজ্ঞানও কতটা মানবনিরপেক্ষ, রাজনীতিমুক্ত থাকতে পারে।

 

 

অবশেষ

প্রায় তিন দশকের সংগ্রাম শেষে ২০২০ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সকলপ্রকার নিয়োনিকোটিনয়েডকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবুও পৃথিবীর বাকি অনেক অঞ্চলে এর ব্যবহার অব্যাহত আছে। এমনকি খোদ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন হতে নিষিদ্ধকরণের তিনমাস পরেই ৩৯০০ টন নিয়োনিকোটিনয়েড রপ্তানি করা হয় বাইরে। সুতরাং এই সমস্যা সমাধা হওয়ার থেকে বহুদূরে রয়েছে এখনও।

 

 

দীর্ঘ ৩০ বছরের সংগ্রামের পর ২০২০ সালে সকল প্রকার নিয়োনিকোটিনয়েড নিষিদ্ধ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। ছবি: Environmental Justice Foundation

 

 

প্রায় তিন দশকের সংগ্রাম শেষে ২০২০ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সকলপ্রকার নিয়োনিকোটিনয়েডকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবুও পৃথিবীর বাকি অনেক অঞ্চলে এর ব্যবহার অব্যাহত আছে। এমনকি খোদ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন হতে নিষিদ্ধকরণের তিনমাস পরেই ৩৯০০ টন নিয়োনিকোটিনয়েড রপ্তানি করা হয় বাইরে। সুতরাং এই সমস্যা সমাধা হওয়ার থেকে বহুদূরে রয়েছে এখনও।

 

বাংলাদেশে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান নিয়োনিকোটিনয়েড যুক্ত কীটনাশক আমদানি করছে। মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গের জন্য তীব্র ক্ষতিকর এই কীটনাশক নিয়ে তেমন কোন গবেষণা এখনো দেশে পরিচালনাও করা হয়নি। ফলে অবারিতভাবেই এই সব ক্ষতিকর পদার্থ প্রকৃতিতে মিশে যাচ্ছে। এগুলো নিয়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থার যেমন গবেষণা করাটা জরুরি, তেমনি প্রয়োজন ব্যক্তিগত ভাবে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও অজস্র গবেষণা। কেননা বহুক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে কীটনাশক ব্যবসায়ীরা সরকারী সংস্থা ও তদারককারীদের ঘুষ কিংবা অন্য কোন উপায়ে প্রভাবিত করতে সক্ষম।

 

কীটনাশক কোম্পানিগুলো বাড়তি মুনাফার জন্য গোটা মানবজাতি, জীবজগৎ এবং সমগ্র প্রকৃতিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়ার অসংখ্য নজিরের মধ্যে নিয়োনিকোটিনয়েড বিষ বাণিজ্য একটি। এমতাবস্থায় স্মরণ করতে হয় সেই নেটিভ আমেরিকান প্রবাদ, "যেদিন শেষ গাছটাও কাটা হয়ে যাবে, শেষ মাছটা শিকার করে ফেলা হবে, শেষ নদীটাও বিষিয়ে ফেলা হবে, সেদিনই মানুষ বুঝবে টাকা চিবিয়ে খাওয়া যায় না।"

 

 

[উক্ত প্রতিবেদনটিতে উল্লেখিত অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক তথ্য Deutsche Welles প্রচারিত প্রামান্যচিত্র বেয়ার অ্যান্ড বি থেকে নেয়া এবং কিছু তথ্য Xerces Society থেকে নেয়া।]

Your Comment