মঙ্গলবার ১০ই বৈশাখ ১৪৩১ Tuesday 23rd April 2024

মঙ্গলবার ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

Tuesday 23rd April 2024

দেশজুড়ে গণমাধ্যম

পেশী প্রদর্শনে আমলাতন্ত্র আগের চেয়েও বেপরোয়া, মনে করেন ৯২.৬% সাংবাদিক

২০২১-০৬-২৭

দৃকনিউজ প্রতিবেদন

পেশী প্রদর্শনে আমলাতন্ত্র আগের চেয়েও বেপরোয়া, মনে করেন ৯২.৬% সাংবাদিক

 

বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা নানা ধরনের সংকট অতিক্রম করছে। চলমান কোভিড-১৯ মহামারিতে মানুষের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ায় সাংবাদিকদের চলাফেরাও সীমিত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো খড়গ রয়েছে সাংবাদিকদের মাথার উপর। এরকম প্রতিকূল অবস্থায় সাংবাদিকরা খবরের খোঁজ বের করতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন। নাগরিকের সঠিক তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অনস্বীকার্য। কিন্তু সংবাদকর্মীদের গ্রেফতার, মামলা, হুলিয়া, আমলাতন্ত্র ও সংঘবদ্ধ শক্তিগুলোর চোখ রাঙানি, পেশী প্রদর্শনী যেন দিন দিন বেড়ে চলেছে। এর প্রেক্ষিতে দৃকনিউজ সংবাদকর্মীদের অধিকার ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।

 

গত ১৭ মে পেশাগত কাজে সচিবালয়ে গেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক অবমাননাকর নিগ্রহের শিকার হন দৈনিক প্রথম আলোর অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম৷ রাজধানীর শাহবাগ থানায় এক রাত আটক ছিলেন তিনি। সেখানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরির অভিযোগে তার নামে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এবং দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় মামলা হয়। ১৮ মে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠান, দীর্ঘ জামিন শুনানি ও কাগজপত্র মূল্যায়নের মধ্যে পাঁচ দিন কাশিমপুর কারাগারে থাকতে বাধ্য হন রোজিনা ইসলাম।

 

এটা সবার জানা যে, সাংবাদিকরা রাষ্ট্র ও ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট নানা গোপন তথ্য জনগণের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে পেশাগতভাবে দায়বদ্ধ। যেখানে জনগণের স্বার্থ রয়েছে, সেখানেই সাংবাদিকদের নজর রাখার অধিকার রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল নিজ স্বার্থ রক্ষার্থে সাংবাদিক ও জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকে রুদ্ধ করতে চায়। রোজিনাকে গ্রেফতারের ঘটনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলারাও আর পিছিয়ে থাকতে রাজি নন, সাংবাদিকদের দমন-নিপীড়নের ক্ষমতা তাদেরও চাই!

 

বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রাতিষ্ঠানিক বাতাবরণের মধ্যে থেকে ধারাবাহিক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। কতিপয় আমলা কর্তৃক রোজিনাকে শায়েস্তার চেষ্টা এবং তাতে রাষ্ট্রের পরোক্ষ সহায়তা তারই অংশ এবং এক ধরনের বিকাশও বটে। দৃকনিউজ তাই এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকদের ত্বরিত প্রতিক্রিয়া সংগ্রহে দ্রুততার সঙ্গে একটি জরিপ পরিচালনা করে। সাংবাদিক রোজিনার হাজতবাস কালেই জরিপের তথ্য সংগ্রহ সম্পন্ন হয়। নিচে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।

 

জরিপের তিনটি প্রশ্ন

১) সাংবাদিক রোজিনাকে গ্রেফতারে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সীমা সংকুচিত হতে পারে কি?

২) আমলাতন্ত্র কি তথ্য লুকোচুরি ও পেশী প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আগের চেয়েও বেপোরোয়া হয়েছে বলে মনে করেন?

৩) সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার নিশ্চিতে মালিকপক্ষের প্রচেষ্টা যথেষ্ট বলে মনে করেন কি?

 

উত্তর হিসেবে হ্যাঁ, না ও নির্বাক- এই তিনটি বিকল্প রাখা হয়। এর বাইরে তথ্যপ্রদান ও মন্তব্যেরও সুযোগ রাখা হয়। সেখানে কেউ কেউ তাদের বিস্তারিত মত তুলে ধরেন।

 

জরিপে প্রাপ্ত ফল

 

জরিপে সাংবাদিক রোজিনাকে গ্রেফতারে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সীমা সংকুচিত হতে পারে কি, এই প্রশ্নের জবাবে ৮১ দশমিক ৯১ শতাংশ হ্যাঁ, ১৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ না এবং ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ নির্বাক ছিলেন।

আমলাতন্ত্র কি তথ্য লুকোচুরি ও পেশী প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আগের চেয়েও বেপোরোয়া হয়েছে বলে মনে করেন, এই প্রশ্নের জবাবে ৯২ দশমিক ৬ শতাংশ হ্যাঁ, ৪ দশমিক ৩ শতাংশ না মতামত দিয়েছেন এবং ৩ দশমিক ২ শতাংশ নির্বাক ছিলেন।

 

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার নিশ্চিতে মালিকপক্ষের প্রচেষ্টা যথেষ্ট বলে মনে করেন কি, এই প্রশ্নের জবাবে ৮৯ দশমিক ৪ শতাংশ না, ৪ দশমিক ৩ শতাংশ হ্যাঁ মতামত দিয়েছেন এবং ৬ দশমিক ৪ শতাংশ নির্বাক ছিলেন।

 

জরিপে যারা অংশ নিয়েছেন

 

দেশের ৯৪ জন সাংবাদিক এই জরিপে অংশগ্রহণ করেন। অনলাইন ও সশরীর, দু’ভাবেই তারা মতামত দিয়েছেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ঢাকাভিত্তিক সাংবাদিক ছিলেন বেশি, ৮৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অন্যদিকে জেলা-উপজেলাভিত্তিক সাংবাদিক ছিলেন ১৭ শতাংশ। অর্ধশতাধিক (৫৫টির বেশি) প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিক এই জরিপে মত দিয়েছেন।

 

অভিজ্ঞতার বিচারে উত্তরদাতাদের বেশিরভাগই তরুণ, ১০ বছরের মধ্যে অভিজ্ঞতা ৬৮ শতাংশের বেশি। পাঁচ বছর বা তার চেয়ে কম সাংবাদিকতা করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রয়েছেন ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, ৬ থেকে ১০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা ৪১ দশমিক ৪৯ শতাংশের। ১১ থেকে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা ২৫ দশমিক ৫৩ শতাংশের, ২১ থেকে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ছিলেন ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

 

বয়সভিত্তিক বিচারে ৩০ বছরের নিচে মত দিয়েছেন ৩৫ দশমিক ১১ শতাংশ, ৩১ থেকে ৩৯ বছরের রয়েছেন ৪৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং ৪০ বছরের বেশি ছিলেন ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

 

লিঙ্গভিত্তিক বিচারে ১৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ নারী এবং ৮৬ দশমিক ১৭ শতাংশ পুরুষ জরিপে অংশগ্রহণ করেন।

 

জরিপে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ সাংবাদিক (৫৪ দশমিক ২৫ শতাংশ) বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বলে তথ্য দিয়েছেন।

 

সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে

 

এই জরিপে অংশগ্রহণকারী সাংবাদিকদের বিস্তারিত তথ্যপ্রদান ও মন্তব্য করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। সেখানে অংশ নিয়ে সাংবাদিকরা নানা ধরনের মন্তব্যের পাশাপাশি কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছেন। সাংবাদিকতার সুষ্ঠু পরিবেশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সংবাদকর্মীদের শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা। সংবাদের জন্য মামলা বা নিপীড়নের মুখোমুখি হলে সংবাদকর্মীর পাশে যদি তার প্রতিষ্ঠান ও সমাজের অন্যরা দাঁড়ায়, তাহলে তিনি ভরসা পান, এগিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কেউ যখন পাশে থাকে না, সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো যখন সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে না, তখন স্বাভাবিকভাবেই নিপীড়কদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়।

 

এই জরিপে প্রাপ্ত তথ্যাবলি কেবল সাংবাদিকদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন নয়, এটা সমাজের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে। দৃকনিউজ মনে করে, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার জন্য সাংবাদিকদের পাশাপাশি সমাজেরও কর্তব্য রয়েছে। নিজ স্বার্থেই জনগণকে অবশ্যই সাংবাদিকতার পরিবেশ রক্ষায় ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পক্ষে সোচ্চার হতে হবে।

 

জরিপ পরিচালনা ও তথ্য বিশ্লেষণী গবেষক দলে কাজ করেছেন সাংবাদিক আনিস রায়হান, নাঈম সিনহা, ইসতিয়াক করিম, সামিয়া রহমান প্রিমা ও পারভেজ আহমেদ রনি। জরিপ ও গবেষণা তত্ত্বাবধান করেছেন সাংবাদিক ও গবেষক ড. সায়দিয়া গুলরুখ। প্রসঙ্গত, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সংবাদকর্মীদের শ্রম অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার ভূমিকা পালন দৃকনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতিমালার অংশ।

Your Comment