শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০ Friday 29th March 2024

শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

Friday 29th March 2024

আন্তর্জাতিক বিশ্ব

বৃষ্টিতে, শীতে, অন্ধকারে

২০২৩-০১-০৯

আঞ্জেল ডি মারিয়া

আঞ্জেল ডি মারিয়ার জন্ম ১৯৮৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ২৫ জুন, ২০১৮ তারিখে আর্জেন্টাইন এই ফুটবলারের হয়ে ওঠার গল্প প্রকাশিত হয়েছিলো দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউন এ। সেই লেখাটির অনুবাদ আমরা প্রকাশ করছি বাংলা ভাষার পাঠকের জন্য।

 

 

২০২২ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর কাপ হাতে সতীর্থদের সঙ্গে আঞ্জেল ডি মারিয়া। ছবি: সিবিএস স্পোর্টস

 

 

রিয়াল মাদ্রিদ থেকে চিঠিটা পাওয়ার কথা মনে আছে আমার, যে চিঠি আমি না খুলেই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।

 

২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের সকাল ছিলো সেটা, ঠিক ১১টা বাজে তখন। পায়ে ইনজেকশন নেওয়ার জন্য ট্রেইনার্স টেবিলে বসে ছিলাম আমি। কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতে গিয়ে আমার উরুর পেশি ছিঁড়ে গিয়েছিলো, কিন্তু ঔষধের সাহায্যে কোনো ব্যথা টের না পেয়েই দৌড়াতে পেরেছিলাম আমি। আমি আমাদের ট্রেইনারদেরকে ঠিক এই কথাগুলো বলেছিলাম: “আমার শরীর যদি ভেঙে যায়, ভেঙে যেতে থাকতে দিন। আমার কিছু আসে যায় না তাতে। আমি শুধু খেলতে পারতে চাই।”

 

ম্যাচের আগে আমি একটা ইঞ্জেকশন নিয়েছিলাম, দ্বিতীয়ার্ধেও নিয়েছিলাম আরেকটা- যাতে বেঞ্চ থেকে আমার ডাক পড়লে আমি প্রস্তুত থাকতে পারি

 

কাজেই আমি পায়ে বরফ লাগাচ্ছিলাম। তখন আমাদের দলের চিকিৎসক দানিয়েল মার্তিনেজ একটা খাম হাতে ঘরে ঢুকে বললেন, “দেখো আঞ্জেল, রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এসেছে এটা।”

 

আমি বললাম, “কীসের কথা বলছো তুমি?”

 

তিনি বললেন, “ওরা বলছে তুমি খেলার মতো অবস্থায় নেই। কাজেই তোমাকে আজকে খেলতে না দেওয়ার জন্য আমাদের জোরাজুরি করছে ওরা।”

 

আমি সাথেসাথে বুঝে গেলাম কী চলছে। বিশ্বকাপের পর জেমস রদ্রিগেজকে দলে নিতে চাইছে রিয়াল- এমন একটা কানাঘুষা সবাইই শুনেছিলো। আমি জানতাম ওর জন্য জায়গা করতে রিয়াল আমাকে বিক্রি করে দিতে চলেছে। কাজেই ওরা চাচ্ছিলো না ওদের জিনিসের কোনো ক্ষতি হোক। বিষয়টা এমনই জলবৎ তরলং ছিলো। এইই হলো ফুটবলের ব্যবসা, যা সবসময় মানুষের চোখে ধরা পড়ে না।

 

আমি দানিয়েলকে বললাম চিঠিটা আমাকে দিতে। আমি জিনিসটা খুললামও না। আমি সেটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে বললাম, “ফেলে দাও এটা। এখানে যে মানুষটা সিদ্ধান্ত নেবে, সে আমি।”

 

আগের রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নি। একটা কারণ হলো, আমাদের হোটেলের বাইরে সারা রাত ধরে ব্রাজিলের ভক্তরা বিশাল বিশাল বাজি পোড়াচ্ছিলো। কিন্তু আমার মনে হয়, সবকিছু একেবারে সুনসান থাকলেও আমি ঘুমাতে পারতাম না। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের রাতে যে অনুভূতি হয় তা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব, বিশেষত যা কিছু নিয়ে আজীবন স্বপ্ন দেখে এসেছি তা যদি ঠিক চোখের সামনে থাকে।

 

আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে গেলেও আমি সেদিন খেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একইসাথে আমি আমাদের দলের জন্য পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে চাইনি। কাজেই আমি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলাম সেদিন, তারপর আমাদের ম্যানেজার মিস্টার সাবেলার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমাদের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলো। সে কারণে আমি জানতাম, আমি যদি তাঁকে বলতাম আমি খেলতে চাই, তিনি আমাকে নামানোর জন্য চাপ বোধ করবেন। আমি বুকে হাত রেখে মন থেকে তাঁকে বললাম, যেই খেলোয়াড়কে নামালে ভালো হবে বলে তিনি মনে করেন, তাকেই তাঁর নামানো উচিৎ।

 

আমি বললাম, “সেটা আমি হলে আমি। অন্য কেউ হলে অন্য কেউ। আমি শুধু এই বিশ্বকাপটা জিততে চাই। আপনি যদি আমাকে বেছে নেন, আমি আমার সবটা ঢেলে দিয়ে খেলবো।”

 

আর তারপর আমি কাঁদতে শুরু করলাম। আমি কান্না আটকাতে পারিনি। আমাকে অভিভূত করে ফেলেছিলো সেই মুহূর্তটা।

 

ম্যাচের আগে টিমের আলোচনার সময়ে সাবেলা ঘোষণা করলেন যে, এনজো পেরেজ নামবে- কারণ তার স্বাস্থ্য শতভাগ ঠিকঠাক আছে। আমি সিদ্ধান্তটাকে ভালোভাবেই নিয়েছিলাম। ম্যাচের আগে আমি একটা ইঞ্জেকশন নিয়েছিলাম, দ্বিতীয়ার্ধেও নিয়েছিলাম আরেকটা- যাতে বেঞ্চ থেকে আমার ডাক পড়লে আমি প্রস্তুত থাকতে পারি।

 

 সে বললো, “তোমার সামনে তিনটা সুযোগ আছে: তুমি আমার সঙ্গে কাজ করতে পারো। তুমি স্কুল শেষ করতে পারো। অথবা তুমি আরো এক বছর ফুটবলে চেষ্টা করতে পারো। কিন্তু তাতে যদি কাজ না হয়, তোমাকে আমার সঙ্গে কাজে লাগতে হবে।”

 

কিন্তু সেই ডাক আর আসেনি। আমরা বিশ্বকাপে হেরে গেলাম। কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো না। সেটা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিন। ম্যাচের পরে আমি কেন খেলিনি তা নিয়ে আজেবাজে কথা বলছিলো সংবাদমাধ্যমগুলো। কিন্তু আমি আপনাদেরকে যা বলছি, তা নির্ভেজাল সত্য।

 

যে মুহূর্তটা আমাকে এখনও তাড়া করে ফেরে তা হলো সাবেলার সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার সময়টা, যখন আমি তাঁর সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। কেননা আমার সবসময়েই মনে হয়, তিনি কি ভাবছিলেন আমি নার্ভাস দেখে কাঁদছি?

সত্যিটা হলো, এখানে নার্ভের কোনো বিষয়ই ছিলো না। ঐ মুহূর্তটা আমার জন্য কতোটা বিশেষ ছিলো, তা ভেবেই আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। অসম্ভব স্বপ্নকে মুঠোয় পাওয়ার খুব কাছাকাছি ছিলাম আমরা।

 

 

আঞ্জেল ডি মারিয়া। ছবি: নিক লাহাম

 

 

আমাদের বাড়ির দেয়ালগুলোর রঙ হওয়ার কথা ছিলো সাদা। কিন্তু সেগুলো কখনও সাদা ছিলো বলে আমার মনে  পড়ে না। প্রথমে ওগুলো ছিলো ধূসর। এরপর কয়লার গুঁড়োয় আস্তে আস্তে দেয়ালগুলো কালোই হয়ে গেলো।  আমার বাবা ছিলো কয়লা শ্রমিক, তবে খনিতে কাজ করা শ্রমিক ছিলো না সে। আসলে সে আমাদের বাড়ির পেছনে বসে চারকোল তৈরি করতো। আপনারা কি কখনও দেখেছেন চারকোল কীভাবে তৈরি হয়? বারবিকিউ করার জন্য চারকোলের যে ছোট ছোট ব্যাগ আপনারা দোকান থেকে কেনেন, সেটা কোনো একটা জায়গা থেকে আসে। আর সত্যি বলতে, কাজটা খুবই নোংরা। আমার বাবা আমাদের আঙিনায় একটা টিনের ছাদের নিচে বসে কাজ করতো। বাজারে নেওয়ার জন্য চারকোলের টুকরোগুলো ব্যাগে ভরতো সে। অবশ্য সে একাই কাজ করতো না। তার খুদে সহকারীরাও ছিলো। স্কুলে যাওয়ার আগে আমি আর আমার ছোট বোন তাকে সাহায্য করতে উঠে পড়তাম। আমাদের বয়স ছিলো নয় কি দশ বছর। চারকোল ব্যাগে ভরার জন্য সেটা একেবারে উপযুক্ত বয়স, কারণ বিষয়টাকে একটা খেলা বানিয়ে নেওয়া যায়। কয়লার ট্রাক আসলে আমাদেরকে প্রথমে লিভিং রুমের মধ্য দিয়ে আর পরে মূল দরজা দিয়ে ব্যাগগুলো নিয়ে যেতে হতো। এভাবে আমাদের ঘরটা ধীরেধীরে কালো হয়ে গেলো।

 

কিন্তু আমাদের টেবিলে খাবার আসতো এভাবেই, আর আমার বাবা এভাবেই আমাদের বাড়িটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছিলো।

 

আমি যখন ছোট, তখন অল্প কিছু দিনের জন্য আমার বাবা-মায়ের অবস্থা ভালো ছিলো। কিন্তু এরপর আমার বাবা একজনের একটা উপকার করার চেষ্টা করলো, আর আমাদের জীবন একেবারে বদলে গেলো। তার এক বন্ধু তাকে তার বাড়ির জামানতকারী হিসেবে সই করতে বললেন। বাবাও তাকে বিশ্বাস করলো। শেষমেশ সেই লোক সময়মতো দেনা শোধ করতে পারলেন না, আর এরপর একদিন স্রেফ হাওয়া হয়ে গেলেন। কাজেই ব্যাঙ্ক সরাসরি আমার বাবার কাছে গেলো। দুটো বাড়ির খরচ জোগানো আর পরিবারকে খাওয়ানোর মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো আমার বাবার জীবন।

 

চারকোল অবশ্য তার প্রথম ব্যবসা ছিলো না। আমাদের বাড়ির সামনের ঘরটাকে তিনি একটা দোকানে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। বড় বড় ড্রামভর্তি ব্লিচ, ক্লোরিন, সাবান আর অন্যান্য সাফাইয়ের জিনিস কিনে আনতো, তারপর সেগুলো ছোট ছোট বোতলে ভরে আমাদের খাওয়ার ঘর থেকে বিক্রি করা হতো। আমাদের শহরে থাকলে তখন কাউকে সিআইএফের বোতল কিনতে যেতে হতো না। সে-জিনিসের অনেক দাম। বরং ডিমারিয়াদের এখানে বেড়াতে আসলে আমার মায়ের কাছে অনেক কম দামে একটা বোতল পাওয়া যেতো।

 

সেই দিন থেকে আমার খেলাধুলার জীবন শুরু হলো। কিন্তু সত্যিটা হলো, লড়াইটা এর অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছিলো। আমার মায়ের আঠা দিয়ে বুট জোড়া লাগানো থেকে, আর বৃষ্টিতে গ্রাসিয়েলায় চড়া থেকে শুরু হয়েছিলো সেটা

 

সবই ভালো যাচ্ছিলো, যতক্ষণ না তাদের বাচ্চা ছেলে প্রায় মরে যাওয়ার উপক্রম করে সবকিছু ভণ্ডুল করে দিলো।

হ্যাঁ, সত্যিই, আমি এমনই মারাত্মক চঞ্চল ছিলাম!

এমনি বাচ্চা হিসেবে আমি খুব একটা খারাপ ছিলাম না, কিন্তু আমার অতিরিক্ত এনার্জি ছিলো। আমি অসম্ভব চঞ্চল ছিলাম। আমার মা একদিন আমাদের “দোকানে” বিক্রিবাট্টা করছিলো, আর আমি ধারেকাছেই খেলছিলাম। খদ্দেররা যাতে আসতে পারে সেজন্য সদর দরজাটা খোলা ছিলো, মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো, আর আমিও হাঁটতে শুরু করলাম… আমি একটু জগতটা দেখতে চেয়েছিলাম!

 

রাস্তার ঠিক মাঝখানে চলে গেছিলাম আমি। আমাকে গাড়ির নিচে চাপা পড়া থেকে বাঁচাতে আমার মাকে রীতিমতো দৌড়ে আসতে হয়েছিলো। মা যেভাবে বলে, তা থেকে মনে হয় ঘটনাটা বেশ নাটকীয় ছিলো। ডি মারিয়াদের সাফাইয়ের দোকানের সেটাই ছিলো শেষ দিন। আমার মা আমার বাবাকে বললো, কাজটা খুবই বিপজ্জনক, কাজেই আমাদের অন্যকিছু খুঁজে নেওয়া প্রয়োজন।

 

সুতরাং এরপর আমার বাবা সেই লোকটাকে খুঁজে বের করলো, যে সান্তিয়াগো দেল এস্তেরো থেকে কয়লার ট্রাক নিয়ে আসে। মজার ব্যাপার হলো, কয়লা বেচার মতো যথেষ্ট টাকাও আমাদের ছিলো না! প্রথম কয়েকটা চালান পাওয়ার জন্য লোকটার কাছে অনেক সাধ্যসাধনা করতে হলো বাবাকে। কাজেই, আমি বা আমার বোন যখন ক্যান্ডি বা অন্য কিছুর আবদার করতাম, আমার বাবা বলতো, “দুটো বাড়ি আর এক ট্রাক কয়লার টাকা যোগাতে হচ্ছে আমাকে!”

 

একটা দিনের কথা মনে আছে আমার। আমি আমার বাবার সাথে বসে চারকোল ব্যাগে ভরছিলাম। খুব ঠাণ্ডা ছিলো সেদিন, বৃষ্টিও হচ্ছিলো। খুব কঠিন ছিলো এর মধ্যে কাজ করা। কয়েক ঘণ্টা পরে আমাকে স্কুলে যেতে হলো, আর স্কুলটা বেশ উষ্ণ ছিলো। আমার বাবা কিন্তু সারাদিন ধরে কাজ করতেই থাকলো। কারণ সেদিন যদি সে কয়লা না বেচতো, আমাদের হয়তো যথেষ্ট খাবার থাকতো না। সত্যিই। আমার মনে আছে আমি মনে মনে ভাবতাম, এবং আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতাম যে: এক সময় সবকিছু বদলে যাবে, আর সেটা ভালোর জন্যই হবে।

 

এর জন্য আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে ফুটবলের কাছে ঋণী।

মাঝেমধ্যে মারাত্মক চঞ্চল হওয়ার কিছু ভালো দিকও থাকে! কম বয়েসেই আমি ফুটবল খেলতে শুরু করেছিলাম, কারণ আমার মায়ের মাথা খারাপ করেদিচ্ছিলাম আমি। আমার বয়স যখন চার, তখন সে একদিন আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো, “ডাক্তার সাহেব, ও কখনো দৌড়ানো থামায়ই না। কী করবো আমি?”

তিনি একজন ভালো আর্জেন্টাইন চিকিৎসক ছিলেন। কাজেই তিনি একেবারে নিশ্চিত জবাবটাই দিলেন, “কী করবেন? ফুটবল।”

কাজেই আমার ফুটবল ক্যারিয়ার আরম্ভ হলো।

 

আমি ফুটবলের বিষয়ে পাগল ছিলাম। সারাক্ষণ এটাই করতাম আমি। আমার মনে আছে, আমি এতো বেশি ফুটবল খেলতাম যে দুই মাস পরপর আমার বুটজোড়া ভেঙে দু-টুকরো হয়ে যেতো, আর নতুন বুট কেনার টাকা ছিলো না বলে আমার মা আঠা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিতো সেগুলো। সাত বছর বয়েসেই আমি নিশ্চয়ই বেশ চৌকস হয়ে উঠেছিলাম, কারণ সে সময়ে আমি আমার পাড়ার দলের  হয়ে ৬৪টা গোল করি। আমার মা এরপর আমার ঘরে এসে বললো, “বেতার কেন্দ্র থেকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে।”

 

সাক্ষাৎকার দিতে বেতার কেন্দ্রে গেলাম আমরা। আমি এমনই লাজুক ছিলাম যে, বলতে গেলে কোনো কথাই বলতে পারিনি।

সে বছরই আমার বাবা রোসারিও সেন্ট্রালের কোচের কাছ থেকে একটা ফোন পেলো। তিনি জানালেন, তাঁরা চান আমি তাঁদের দলে খেলি। পরিস্থিতিটা বেশ মজার ছিলো এজন্য যে, আমার বাবা আসলে নিউয়েলস ওল্ড বয়েজের পাঁড় সমর্থক ছিলো। অন্যদিকে আমার মা ছিলো রোসারিও সেন্ট্রালের বিরাট ভক্ত। আপনার বাড়ি যদি রোসারিওতে না হয়, তাহলে আপনি ধারণাও করতে পারবেন না এই দুই দলের দ্বৈরথ কতোটা উত্তেজনার বিষয় ছিলো। একেবারে জীবন-মরণ বিষয় ছিলো সেটা। যখন ক্লাসিক চলতো, তখন প্রতিটা গোল হওয়ার সাথেসাথে আমার মা-বাবা একেবারে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতো, আর যার দল জিততো সে বাকি মাস ধরে ক্ষেপিয়ে যেতো অপরজনকে।

 

কাজেই বুঝতেই পারছেন, সেন্ট্রাল থেকে যখন আমাকে ডাকা হলো তখন আমার মা কতোটা উত্তেজিত ছিলো।

বাবা বললো, “আমি আসলে জানি না। জায়গাটা তো অনেক দূর। নয় কিলোমিটার! আমাদের গাড়িও নেই! ওকে আমরা পাঠাবো কীভাবে?”

মা বললো, “না, না, না! চিন্তা কোরো না, আমি ওকে নিয়ে যাবো! এটা  কোনো সমস্যাই না!”

এই সময়েই গ্রাসিয়েলার জন্ম হলো।

 

আর্জেন্টিনায় ফুটবল খেলায় জায়গা করে নিতে হলে যা যা করা দরকার তার সবই আপনাকে করতে হবে। যে প্লেনই আসুক না কেন, কোনো প্রশ্ন না করেই তাতে চড়ে বসতে হবে আপনাকে

 

গ্রাসিয়েলা ছিলো একটা মরচেপড়া পুরনো হলুদ বাইসাইকেল, যেটাতে করে আমার মা রোজ আমাকে ট্রেনিংয়ে নিয়ে যেতো। গ্রাসিয়েলার সামনে একটা ছোট্ট ঝুড়ি ছিলো, পেছনে আরেকজন মানুষের বসার জায়গা ছিলো। তারপরও সমস্যা কিন্তু রয়েই গেলো, কারণ আমার ছোট বোনকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হতো। কাজেই আমার বোনকে বসানোর জন্য বাবা গ্রাসিয়েলার পাশটাতে একটা ছোট্ট কাঠের পাটাতন তৈরি করে দিলো।

দৃশ্যটা ভাবুন একবার: পেছনে একটা বাচ্চা ছেলে, পাশে একটা ছোট্ট মেয়ে আর আমার বুট আর কিছু খাবারদাবারের একটা ব্যাগ নিয়ে শহরের মধ্য দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে আমার মা। পাহাড়ি রাস্তার চড়াইয়ে, উৎরাইয়ে। বিপজ্জনক এলাকা দিয়ে। বৃষ্টিতে। শীতে। অন্ধকারে। কোনোকিছুতেই কিছু যেতো আসতো না। আমার মা সাইকেল চালিয়েই যেতো।

 

আমাদের যেখানেই যাওয়া দরকার হোক না কেন, গ্রাসিয়েলা নিয়ে যেতো আমাদের।

কিন্তু সত্যিটা হলো, সেন্ট্রালে আমার সময়টা সহজ ছিলো না। আসলে আমার মা না থাকলে আমি ফুটবল ছেড়েই দিতাম। দুবার ছেড়ে দিতাম সত্যি বলতে। আমার বয়স যখন ১৫, তখনও আমি ঠিকঠাকমতো বেড়ে উঠছিলাম না। আমাদের একজন কোচ একটু উদ্ভট ছিলেন। একটু হাট্টাকাট্টা গড়নের আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়দের প্রাধান্য দিতেন তিনি, আর আমি একেবারেই সে ধরনের ছিলাম না। একদিন আমি বক্সে হেড দেয়ার জন্য লাফিয়ে ওপরে উঠিনি। সেদিন ট্রেনিংয়ের শেষে সব খেলোয়াড়কে জড়ো করলেন তিনি, তারপর আমার দিকে ঘুরলেন…
 

তিনি বললেন, “তুমি একেবারে দুধভাত। তোমাকে নিয়ে লজ্জা হয়। তোমাকে দিয়ে কখনো কিছু হবে না। তুমি চরম ব্যর্থ হবে।”

আমি একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। তিনি কথা শেষ করার আগেই আমি আমার সতীর্থদের সবার সামনে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে মাঠ ছেড়ে চলে গেলাম।

বাড়ি ফিরে আমি একলা কাঁদার জন্য সোজা নিজের ঘরে চলে গেলাম। আমার মা জানতো কিছু একটা হয়েছে, কারণ প্রতি রাতে ট্রেনিং থেকে ফেরার পর আমি রাস্তায় গিয়ে আবার খেলতাম। সে আমার ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করলো কী হয়েছে। আমি তাকে সত্যি সত্যি যা ঘটেছে সেটা বলতে আসলেই ভয় পাচ্ছিলাম, কারণ আমার মনে হচ্ছিলো সবটা জানলে সে পুরো রাস্তা সাইকেল চালিয়ে গিয়ে কোচকে ঘুষি মারার চেষ্টা করবে। সে খুবই শান্ত মানুষ ছিলো, কিন্তু তুমি যদি তার বাচ্চাদের কোনো কষ্ট দাও… জলদি পালাও!

 

সময়ে সময়ে মনে হতো, খুব বড়ো একটা ভুল হয়ে গেছে। আমি শুরু করতে পারছিলাম না। সব ছেড়েছুড়ে বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করতো আমার

 

আমি মাকে বললাম মারামারি করে এসেছি, কিন্তু সে জানতো আমি মিথ্যা বলছি। কাজেই এসব ক্ষেত্রে সব মা যা করে সেও সেটাই করলো- ঘটনাটা জানতে আমার এক সতীর্থের মাকে ফোন করলো।

মা যখন আমার ঘরে ফিরে আসলো, আমি তখন ভয়ানক কাঁদছিলাম। আমি তাকে বললাম্ম, আমি ফুটবল খেলা ছেড়ে দিতে চাই। পরদিন আমি বাড়ির বাইরেই বের হতে পারছিলাম না। আমি স্কুলে যেতে চাচ্ছিলাম না। আমি অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছিলাম। কিন্তু তারপর আমার মা আমার বিছানায় বসে বললো, “তুমি ফিরে যাচ্ছো, আঞ্জেল। তুমি আজকে ফিরে যাচ্ছো। তোমাকে তার কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে।”

 

আমি সেদিনই ট্রেনিংয়ে ফিরে গেলাম, আর সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটা ঘটলো। আমার সতীর্থরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করলো না। তারা আসলে আমাকে সাহায্যও করলো। বলটা যখন শূন্যে ভাসছিলো, তখন ডিফেন্ডাররা আমাকে হেড দেওয়ার সুযোগ দিলো। আমি যাতে ভালো বোধ করি সেটা নিশ্চিত করেছিলো তারা, আর সত্যিই সেদিন তারা আমার খেয়াল রেখেছিলো। ফুটবল একটা প্রতিযোগিতামূলক খেলা, বিশেষত দক্ষিণ আমেরিকায়। প্রত্যেকেই এর মধ্য দিয়ে অবস্থার উন্নতি করতে চায়, জানেন তো? কিন্তু ঐ দিনটার কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে, কারণ আমার সতীর্থরা বুঝতে পেরেছিলো আমি কষ্ট পাচ্ছি, আর তারা আমাকে সাহায্য করেছিলো।

 

তারপরও আমি ছোটখাটো এবং ক্ষীণকায় ছিলাম। আমি সেন্ট্রালের সিনিয়র দলে জায়গা পাচ্ছিলাম না, আর আমার বাবা চিন্তিত হয়ে পড়ছিলো বিষয়টা নিয়ে। একদিন রাতে আমরা রান্নাঘরের টেবিলে বসে ছিলাম। তখন সে বললো, “তোমার সামনে তিনটা সুযোগ আছে: তুমি আমার সঙ্গে কাজ করতে পারো। তুমি স্কুল শেষ করতে পারো। অথবা তুমি আরো এক বছর ফুটবলে চেষ্টা করতে পারো। কিন্তু তাতে যদি কাজ না হয়, তোমাকে আমার সঙ্গে কাজে লাগতে হবে।”

 

আমি কিছু বললাম না। পরিস্থিতিটা জটিল ছিলো। টাকার দরকার ছিলো আমাদের।

কথা বললো আমার মা। সে বললো, “ফুটবলে আরো এক বছর।”

সেটা ছিলো জানুয়ারিতে।

ডিসেম্বরে, মানে একেবারে শেষ মাসে… সেন্ট্রালের প্রিমেরা দিবিসিওনে আমার অভিষেক হলো।

 

সেই দিন থেকে আমার খেলাধুলার জীবন শুরু হলো। কিন্তু সত্যিটা হলো, লড়াইটা এর অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছিলো। আমার মায়ের আঠা দিয়ে বুট জোড়া লাগানো থেকে, আর বৃষ্টিতে গ্রাসিয়েলায় চড়া থেকে শুরু হয়েছিলো সেটা। আমি যখন আর্জেন্টিনার একজন পেশাদার খেলোয়াড় হয়ে উঠলাম, তখনও এটা লড়াইই ছিলো। আমার মনে হয় না দক্ষিণ আমেরিকার বাইরের মানুষ বুঝতে পারবে বিষয়টা কেমন ছিলো। একে বিশ্বাস করার জন্য এসব অভিজ্ঞতার কিছুটা যাপন করা দরকার।

 

কলম্বিয়ায় নাসিওনালের বিপরীতে একবার আমাদের লিবের্তাদোরেসে খেলতে হয়েছিলো। সেই অভিজ্ঞতা আমি কখনোই ভুলবো না, কারণ আকাশপথের সেই যাত্রা প্রিমিয়ার লীগ অথবা লা লিগার মতো ছিলো না। এমনকি বুয়েনোস আইরেসে খেলার মতোও নয় ব্যাপারটা। কারণ সে সময়ে রোসারিওতে কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছিলো না। বিমানবন্দরে গিয়ে যে বিমানই থাকুক না কেন, তাতে উঠে পড়তে হতো। কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ ছিলো না।

 

কাজেই আমরা কলম্বিয়ার বিমানের জন্য সেখানে উপস্থিত হলাম… রানওয়েতে একটা বিরাট কার্গো বিমান ছিলো। যে বিমানগুলোয় গাড়ির মতো জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করার জন্য পেছনে বড়ো র‍্যাম্প থাকে, তারই একটা। সেটাই ছিলো আমাদের বিমান। আমার মনে আছে, বিমানটার নাম ছিলো “হারকিউলিস”।

 

আমার মনে হয় মানুষ এখন ইনস্টাগ্রাম অথবা ইউটিউবে শুধু ফলটাই দেখে, কিন্তু দামটা দেখে না। যাত্রাটা দেখে না তারা। তারা দেখে আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে আমি চ্যাম্পিয়নস লীগ ট্রফির পাশে হাসছি, আর তারা ভাবে সবকিছু একেবারে নিখুঁত

 

র‍্যাম্পটা নিচে নেমে আসলো, আর শ্রমিকরা প্লেনের ভেতরে এতো এতো ম্যাট্রেস ওঠাতে শুরু করলো।

খেলোয়াড়েরা সবাই একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছিলাম। মানে, হচ্ছেটা কী?

আমরা বিমানে উঠতে গেলাম, কিন্তু শ্রমিকেরা আমাদের বললো, “না না, তোমরা পেছনে ওঠো। আর এই হেডফোনগুলো নাও।”

 

শব্দ থেকে বাঁচতে আমাদেরকে সেই বিরাট মিলিটারি হেডফোনগুলো দিয়েছিলো তারা। আমরা প্ল্যাটফর্মে উঠলাম। আমাদের জন্য অল্প কয়েকটা আসন ছিলো, কয়েকটা ম্যাট্রেস ছিলো শুয়ে পড়ার জন্য। আট ঘণ্টা মোট। লিবের্তাদোরেসের একটা ম্যাচের জন্য। ওরা র‍্যাম্পটা বন্ধ করে দিলো, আর জায়গাটা বেজায় অন্ধকার হয়ে গেলো। হেডফোন কানে লাগিয়ে সটান ম্যাট্রেসে শুয়ে ছিলাম আমরা, একজন আরেকজনের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম বললেই চলে। বিমান টেক অফ করতে শুরু করলো, আর আমরা র‍্যাম্প থেকে খানিকটা পিছলে একেবারে বিমানের পেছনের দিকে চলে যেতে শুরু করলাম। আমাদের এক সতীর্থ চেঁচিয়ে বললো, “কেউ বড় লাল বোতামটায় হাত দিও না! ঐ দরজাটা খুলে গেলে আমরা সবাই শেষ!”

 

বিষয়টা অবিশ্বাস্য ছিলো। এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না গেলে একে বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু আপনি আমার সতীর্থদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। এমনটা সত্যিই ঘটেছিলো। এই ছিলো আমাদের ব্যক্তিগত বিমানের ভার্সন। হারকিউলিস!

 

তারপরও এই স্মৃতিটা আমার জন্য অনেক আনন্দ নিয়ে আসে। আর্জেন্টিনায় ফুটবল খেলায় জায়গা করে নিতে হলে যা যা করা দরকার তার সবই আপনাকে করতে হবে। যে প্লেনই আসুক না কেন, কোনো প্রশ্ন না করেই তাতে চড়ে বসতে হবে আপনাকে।

 

এরপর সুযোগ আসলে আপনাকে বিমানে চড়তে হবে ওয়ান-ওয়ে টিকেট হাতে। সে সুযোগটা আমার এসেছিলো বেনফিকার সঙ্গে পর্তুগালে। অনেকে হয়তো আমার ক্যারিয়ারের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করেছিলো, “বাহ, ও বেনফিকা, তারপর রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, পিএসজি সবখানে গেছে।” হয়তো বিষয়টা দেখতে খুব সহজ মনে হয়। কিন্তু তার মাঝখানে কতো কী ঘটেছে তা কেউ ভাবতে পারবে না। ১৯ বছর বয়সে বেনফিকায় গিয়ে আমি দুটো সিজনও ঠিকমতো খেলিনি। আমার বাবা আমার সাথে পর্তুগালে চলে আসার জন্য কাজ ছেড়ে দিলো। আমার মা আর তার মধ্যে তখন দূরত্ব টেনে দিয়েছে একটা মহাসাগর। কোনো কোনো রাতে আমি শুনতে পেতাম, আমার মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে গিয়ে কাঁদছে সে, কারণ মাকে সে অসম্ভব মিস করছে।

 

সময়ে সময়ে মনে হতো, খুব বড়ো একটা ভুল হয়ে গেছে। আমি শুরু করতে পারছিলাম না। সব ছেড়েছুড়ে বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করতো আমার।

এরপর ২০০৮ সালের অলিম্পিক আমার গোটা জীবনটাই বদলে দিলো। বেনফিকায় আমার শুরুটা না হলেও আর্জেন্টিনা দল তাদের হয়ে আমাকে খেলতে ডাকলো। আমি কোনোদিন সেটা ভুলবো না। এই টুর্নামেন্টে আমি অতিমানবিক, জিনিয়াস লিও মেসির সঙ্গে খেলার সুযোগ পাই। সে সময়টাতেই আমি ফুটবল খেলে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি। একমাত্র যা আমাকে করতে হতো তা হলো দৌড়ানো। দৌড়ানো শুরু করলেই বলটা কেমন করে যেন আমার পায়ে চলে আসতো। যেন জাদু।

 

 

আঞ্জেল ডি মারিয়া এবং লিওনেল মেসি। ছবি: রয়টার্স

 

 

আপনার-আমার চোখ যেভাবে কাজ করে, লিওর চোখ সেভাবে কাজ করে না। মানুষের চোখের মতো আশেপাশে তো ও দেখেই, উপরন্তু পাখির মতো দুনিয়াটাকে ওপর থেকেও ও দেখতে পারে। আমি বুঝি না এটা কীভাবে সম্ভব।

নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ফাইনাল পর্যন্ত যেতে সমর্থ হলাম আমরা। আর সেটাই ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে অসাধারণ দিন। আর্জেন্টিনার জন্য গোল্ড মেডেলটা জিততে গোলটা করেছিলাম আমি… এই অনুভূতি বলে বোঝানো সম্ভব না।

আপনাকে বুঝতে হবে। আমার বয়স তখন ২০, আমি এমনকি বেনফিকার হয়েও খেলছি না। আমার পরিবারকে আলাদা হতে হয়েছে। আর্জেন্টিনা ঐ টুর্নামেন্টের জন্য আমাকে ডাকার আগে হতাশার একটা সময় যাচ্ছিলো। মাত্র দুই বছরে আমি একটা গোল্ড মেডেল জিতলাম, বেনফিকার হয়ে খেলতে শুরু করলাম, আর তারপর আমি রিয়াল মাদ্রিদে আসলাম।

 

 

আমার স্বপ্ন বহুবার শেষ হয়ে যেতে যেতেও যায়নি। আমার বাবা টিনের ছাদের নিচে কাজ করে গেছে… আমার মা সাইকেল চালিয়ে গেছে… আমি দৌড়েই গেছি…

 

সেটা কেবল আমার জন্যই একটা গৌরবের মুহূর্ত ছিলো না, বরং তা ছিলো আমার পুরো পরিবার,  আমার সব বন্ধু আর সতীর্থের জন্যও, যারা বছরের পর বছর ধরে আমার পাশে থেকেছে। শুনেছি আমার বাবা আমার চেয়েও ভালো ফুটবলার ছিলো, কিন্তু কম বয়সে হাঁটুতে চোট পাওয়ায় তার স্বপ্ন ভেঙে যায়। আমি শুনেছি আমার দাদা আমার বাবার থেকেও ভালো ফুটবলার ছিলো, কিন্তু একটা রেল দুর্ঘটনায় তার দুটো পা-ই কাটা পড়ে, আর তার স্বপ্নও শেষ হয়ে যায়।

 

আমার স্বপ্ন বহুবার শেষ হয়ে যেতে যেতেও যায়নি।

আমার বাবা টিনের ছাদের নিচে কাজ করে গেছে… আমার মা সাইকেল চালিয়ে গেছে… আমি দৌড়েই গেছি…

আমি জানি না আপনারা ভাগ্যে বিশ্বাস করেন কিনা। কিন্তু আমি যখন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে প্রথম গোলটা করি, তখন আমরা যে দলের হয়ে খেলছিলাম তার নাম কী জানেন?

হারকিউলিস সিএফ।

আমরা অনেক দূর এসেছি।

কাজেই এখন আমার মনে হয় আপনারা বুঝতে পারছেন বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে কেন আমি সাবেলার সামনে কাঁদছিলাম। আমি নার্ভাস ছিলাম না। আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না। ম্যাচে আমি নামছি কিনা, তা নিয়েও চিন্তিত ছিলাম না আমি।

 

বুকে হাত রেখে বলতে পারি, আমি শুধু আমাদের স্বপ্নটা ছুঁতে চেয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম, আমাদেরকে আমাদের দেশে কিংবদন্তি হিসেবে মনে রাখা হোক। আমরা খুব কাছাকাছি ছিলাম…

সেজন্যই আর্জেন্টিনার গণমাধ্যমে আমাদের দলের সম্বন্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাটা এতো হৃদয়বিদারক। সময়ে সময়ে নেতিবাচকতা আর সমালোচনা একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এয়া স্বাস্থ্যকর না। আমরা সবাইই মানুষ, আর আমাদের সবার জীবনেই এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে যা মানুষ জানতে পারে না।

 

এমনকি চূড়ান্ত নির্ধারণী খেলার আগে আমি একজন মনোবিদের কাছে যেতে শুরু করি। আমার মনের ভেতর আমি একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। সাধারণত এ ধরনের সময় থেকে আমাকে বের করে আনার জন্য আমি আমার পরিবারের ওপরেই পুরোপুরি নির্ভর করি। কিন্তু এইবার জাতীয় দলের কারণে মানসিক চাপটা এতো বেশি ছিলো যে, আমি একজন মনোবিদের কাছে যাই। এটা সত্যিই আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। চূড়ান্ত দুই ম্যাচে আমি অনেক বেশি সহজ আর স্বচ্ছন্দ ছিলাম।

 

আমি নিজেকে মনে করিয়েছি যে, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দলগুলোর একটার অংশ আমি, আর আমি আমার দেশের জন্য খেলছি। আমার ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। মাঝেমধ্যে পেশাদার হিসেবে এসব সরল সত্য ভুলে যেতে পারি আমরা।

খেলাটা আবারও খেলা হয়ে উঠলো।

 

আমার মনে হয় মানুষ এখন ইনস্টাগ্রাম অথবা ইউটিউবে শুধু ফলটাই দেখে, কিন্তু দামটা দেখে না। যাত্রাটা দেখে না তারা। তারা দেখে আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে আমি চ্যাম্পিয়নস লীগ ট্রফির পাশে হাসছি, আর তারা ভাবে সবকিছু একেবারে নিখুঁত। কিন্তু ওরা জানে না, এই ছবি তোলার মাত্র এক বছর আগে আমার মেয়ে সময়ের আগে জন্মেছিলো। নল আর তারে জড়াজড়ি হয়ে দুই মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো তাকে।

 

 

বিশ্বকাপ জয়ের পর স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে আঞ্জেল ডি মারিয়া। ছবি: ডি মারিয়ার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট

 

ওরা হয়তো আমাকে একটা ছবিতে ট্রফির সঙ্গে কাঁদতে দেখে ভাবে, আমি ফুটবলের জন্য কাঁদছি। কিন্তু সত্যি বলতে, আমি কাঁদছি কারণ আমার মেয়ে এই সময়টায় আমার সঙ্গে আছে।

বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতে গিয়ে ওরা শুধু ফলটাই দেখে।

০-১।

কিন্তু ওরা দেখে না, এ পর্যন্ত আসতে গিয়ে আমাদের অনেককে কতোটা লড়াই করতে হয়েছে।

আমাদের লিভিং রুমের দেয়াল সাদা থেকে কালো হয়ে যাওয়ার গল্পটা ওরা জানে না।

আমার বাবার টিনের ছাদের নিচে কাজ করার কথা ওরা জানে না।

সন্তানদের জন্য বৃষ্টিতে আর ঠাণ্ডায় আমার মায়ের গ্রাসিয়েলায় চড়ে যাওয়ার কথা জানে না ওরা।

ওরা হারকিউলিসের কথা জানে না।

 

অনুবাদ: দীপান্বিতা কিংশুক ঋতি

Your Comment