মহানবীকে লক্ষ্য করে বিজেপির নেতা নূপুর শর্মার মন্তব্য ঘিরে বিশ্ব উত্তপ্ত। বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে নূপুর শর্মাকে বিজেপি শাস্তি দিলেও পর্যবেক্ষকদের অনুমান, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিজেপির মুসলিম-বিদ্বেষী তৎপরতা অব্যাহতই থাকবে। ইতিহাস বদলের চেষ্টা, পাঠ্যবইতে সাম্প্রদায়িক উপকরণ বৃদ্ধি, রাজনীতিতে হিংসা ছড়ানো বুলি— এসবই তার লক্ষণ। দৃকনিউজের পাঠকদের জন্য আমরা এই বিষয়ে বাছাই করা কিছু মৌলিক প্রবন্ধ এবং অনুবাদ প্রকাশ করছি। তার ধারাবাহিকতায় রয়টার্সের একটি বিশ্লেষণ আজ প্রকাশ করা হলো। লেখাটি বিজেপির পাঠ্যসূচিতে ভারতের ইতিহাস পুনর্লিখন প্রকল্পের তাৎপর্য বুঝতে সাহায্য করবে।
কেবল হিন্দু জনগোষ্ঠী যে ভারতের আদিম অধিবাসীদের বংশধর, তা প্রমাণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার পণ্ডিতদের একটি কমিটি নিয়োগ দিয়েছে ২০১৮ সালে। দেশটির সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের সদস্যরা এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে, এই তৎপরতার মধ্য দিয়ে সরকার তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করতে চায়।
“আমরা গণেশ দেবের উপাসনা করি। হয়তো সেকালে কোনো প্লাস্টিক সার্জন ছিলেন, যিনি একজন মানুষের শরীরের ওপর একটা হাতির মাথা বসিয়ে দিয়েছিলেন। এমন অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা রেখেছেন বিরাট ভূমিকা।”– নরেন্দ্র মোদি, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। আলোকচিত্র: সৌরভ দাস/এপি
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে একদল ভারতীয় পণ্ডিত নয়া দিল্লীর এক মনোরম সড়কের পাশে একটি ঝকঝকে বাংলোয় সমবেত হন। তাদের আলোচনার কেন্দ্র ছিল: কীভাবে জাতির ইতিহাস পুনর্লিখন করা যায়।
এর মাস ছয়েক আগে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার বিশেষজ্ঞদের এই কমিটিকে চুপচাপ নিয়োগ দিয়েছিল। সেই কমিটির অস্তিত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রথমবারের মত এই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
রয়টার্সের পর্যালোচনা করা সভার কার্যবিবরণী এবং কমিটি সদস্যদের সাক্ষাৎকার থেকে এই কমিটির উদ্দেশ্যটুকু পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সেটা হল প্রত্নতাত্ত্বিক সন্ধান আর ডিএনএর মত নজির কাজে লাগিয়ে এটা প্রমাণ করা যে, কয়েক হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে প্রথম যে মানুষেরা বাস করতেন, আজকের হিন্দুরা তাদের সরাসরি বংশধর। আরেকটা উদ্দেশ্য: প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো যে অতিকথা নয়, বরং বৈজ্ঞানিক সত্য, তা প্রতিষ্ঠা করা।
১৪ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির সদস্য আর মোদি সরকারের মন্ত্রীদের সাক্ষাৎকার থেকে এর উদ্দেশ্য নিয়ে একটা ইঙ্গিত মেলে। সেই ইঙ্গিতটা হলো হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উদ্দেশ্য বহু ধর্মের বহুবর্নিল নকশা ১৩০ কোটি মানুষের জাতিরাষ্ট্রটাতে কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার মধ্যেই সীমিত নয়। তাদের চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা হল জাতীয় পরিচয়কে তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা, যে দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ভারত কেবল হিন্দুদের রাষ্ট্র, এবং কেবল হিন্দুদের এখানে স্থান মিলবে।
এটা করতে গিয়ে ভারত যে বহুসাংস্কৃতিক একটি রাষ্ট্র, সেই বয়ানের দিকে তারা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন। পুরনো বয়ানটি অনুযায়ী, আজকের দিনের ভারত একটা শিল্পকর্ম, যা অভিবাসন, আগ্রাসন আর ধর্মান্তরের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির শিকড় জনমিতিক তথ্য-উপাত্তের মাঝে নিহিত। ভারতীয়দের মধ্যে হিন্দুরা সংখ্যাগুরু হলেও মুসলমানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটির কাছাকাছি, দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ।
কমিটির সভাপতি কে এন দীক্ষিত রয়টার্সকে বলেন, “আমাকে এমন একটা প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে, যা সরকারকে প্রাচীন ইতিহাসের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য পুনর্লিখন করতে সহায়তা করবে।”
এই কমিটি গঠন করেছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী মহেশ শর্মা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে এটা নিশ্চিত করেছেন যে তাদের কাজ ভারতের ইতিহাস সংশোধন করার এক বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ।
যা ঘটে চলেছে তা ভারতের মুসলমানদের জন্য অশুভ ইঙ্গিতবাহী। তারা ২০১৪ সালে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে দেশটিতে ঘটা ধর্মীয় সহিংসতা আর বৈষম্যের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আর কোনোদিনই এতটা কোনঠাসা অনুভব করেননি। তাদের একজন নেতা বলেন, “এই সরকার চায় মুসলমানরা ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বাস করুক।”
রয়টার্স এই নিবন্ধের বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য জানতে অনুরোধ করলে তিনি তাতে সাড়া দেন নি।
পাঠ্যক্রমে নতুন ইতিহাস আরোপের তৎপরতা
ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক উস্কে দেয়ার পেছনে একটি আদর্শিক, জাতীয়তাবাদী হিন্দু সংগঠনের হাত আছে। দলটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) নামে পরিচিত। ২০১৪ সালে আরএসএস মোদির ভারতীয় জনতা পার্টিকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিল। এই কমিটি তৈরির সময়ে দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়, মহাসড়ক আর অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারা এই সংগঠনের সদস্য।
আরএসএসের দাবি ভারতীয় উৎসের সব মানুষের পূর্বপুরুষ হিন্দু, দেশটির ১৭ কোটি ২০ লাখ মুসলমান যাদের অন্তর্ভূক্ত। ভারতমাতার অংশ হিসেবে তাদের সবাইকেই একটা একক সাধারণ উৎস মেনে নিতে হবে। মোদি সেই শৈশব থেকেই আরএসএসের একজন সদস্য। সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী মহেশ শর্মার একটি আনুষ্ঠানিক জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছে, তিনিও বহুবছর ধরে আরএসএসের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতীকী বর্ণের প্রতি দিকনির্দেশ করে আরএসএসের মুখপাত্র মনমোহন বৈদ্য রয়টার্সকে জানিয়েছেন, “ভারতীয় ইতিহাসের আসল রঙ গেরুয়া এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনার জন্য আমাদেরকে ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে।”
আরএসএসের ঐতিহাসিক গবেষণা শাখার প্রধান বালমুকুন্দ পাণ্ডে বলেন, শর্মার সাথে প্রায়ই তার দেখা হয়। পাণ্ডের মতে, ভারতের অতীত গৌরব পুনর্বহাল করার ‘সমূহ সময় উপস্থিত’, প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রগুলো যে অতিকথা নয়, সত্য তা প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়েই তা সম্ভবপর হবে।
মহেশ শর্মা রয়টার্সকে বললেন তিনি আশা করেন কমিটি যে সিদ্ধান্ত টানবে তা বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই আর বিদ্যায়তনিক গবেষণায় পথ করে নেবে। সরকারি নথিপথে এই প্যানেলটিকে “আজ থেকে ১২ হাজার বছর আগে ভারতীয় সংস্কৃতির উদ্ভব, এর বিবর্তন ও দুনিয়ার অন্যান্য সংস্কৃতির সাথে আদানপ্রদান বিষয়ে একটি সামগ্রিক সমীক্ষা” চালানোর কমিটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
শর্মা বলেছেন, ভারতীয় ইতিহাসের এই ‘হিন্দু প্রথম’ সংস্করণটি বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা হবে। পুরনো পাঠ্যক্রমটি দীর্ঘদিন ধরে শিখিয়ে আসছে যে, মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে মানুষজনের আগমন ও জনসমাজের রূপান্তর অনেক বেশি সাম্প্রতিক ঘটনা। ৩ থেকে ৪ হাজার বছর আগে তা ঘটেছে।
“ভারতীয় ইতিহাসের আসল রঙ গেরুয়া এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনার জন্য আমাদেরকে ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে।”– মনমোহন বৈদ্য, মুখপাত্র, আরএসএস। আলোকচিত্র: ডিএনএ ইন্ডিয়া
ভারত যে গণ অভিবাসনের দরুণ গঠিত হয়েছিল, মোদির দলের শীর্ষপর্যায়ের সদস্যগণ আর হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সেই ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বিশ্বাস করেন আজকের হিন্দুরা দেশটির প্রথম বাসিন্দাদের থেকেই উদ্ভূত হয়েছেন। ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারের মতে, ভারতের মাটিতে কে প্রথম পা রেখেছে সেটা জাতীয়তাবাদীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ হল, “হিন্দুদেরকে যদি একটি হিন্দু রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে অগ্রগণ্য করতে হয়, তাদের ভিত্তিস্বরূপ ধর্মটা আমদানিকৃত হলে চলে না।” নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুবছর শিক্ষকতা করা এবং প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিষয়ে একাধিক গ্রন্থ প্রণেতা ৮৬-বছর-বয়সী থাপারের মতে, নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে হিন্দুদের অগ্রগণ্যতায় জোরারোপ করার জন্যই জাতীয়তাবাদীদের প্রয়োজন হয় নিজেদেরকে প্রাচীন অধিবাসীদের বংশধর দাবি করার, প্রয়োজন হয় এই ভূমিতে জন্ম এমন একটা ধর্মের উত্তরাধিকার দাবি করার। আজ থেকে ৩-৪ হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে বিপুল হারে জন আগমন ঘটেছিল, ব্রিটিশ আমল থেকেই এই তত্ত্বটি সমাদৃত হয়ে আসছে।